করোনার কালো দাগ এখনও মুছে যায়নি। তবু প্রশস্ত পৃথিবী সংকুচিত হচ্ছে মজুতদারির জন্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। কোথাও যুদ্ধের দামামা বাজছে, কোথাও প্রকৃতির রোষানলে আগুন জ্বলছে। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতাও দেখতে হতে পারে আমাদের। সংবাদমাধ্যমে জানা যাচ্ছে, অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপে একবেলা কম খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন উন্নত দেশের মধ্যবিত্তরা। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দফায় দফায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে তুলছে। সরবরাহ সংকট না থাকলেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করছে। অথচ রাসুল (সা.) মজুতদারকে গোনাহগার, অভিশপ্ত ও সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৩৮)।
তাকওয়ার শিক্ষা জরুরি : ইতিহাস সাক্ষী, বাজার অস্থিতিশীল করার কারণে শোয়াইব (আ.)-এর উম্মতকে আল্লাহতায়ালা চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছেন। একশ্রেণির ব্যবসায়ী এতটাই বেপরোয়া যে, মানুষের রক্তচোষা যেন তাদের একমাত্র টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে দাম বাড়লে এক-দুটো পণ্যের দাম বাড়ত, এখন সব পণ্যের দাম হু-হু করে বাড়িয়ে দিচ্ছে সিন্ডিকেট। মহামারি বা বিপদাপদসহ কোনো একটা দুর্যোগ বা প্রয়োজনের আভাস পেলেই এরা যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
মানুষের বিপদ পুঁজি করে মুনাফার স্বপ্ন দেখে তারা। শত বলে-কয়েও মজুতদারি রোখা যাচ্ছে না। আসলে ব্যক্তির ভেতর যদি আল্লাহভীতি জাগানো না যায়, তাহলে আইন করে কখনও দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। তাই তো রাসুল (সা.) আইন প্রণয়ণের আগে মানুষের ভেতর তাকওয়া জাগিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করবে, সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে। আর যে গুদামজাত করবে, সে অভিশপ্ত হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৪৪)।
শয়তান যা ভুলিয়ে রাখে : আমাদের দেশে আইনের চেয়ে ধর্মীয় অনুভূতির কারণে মানুষ গোনাহ থেকে বিরত থাকে বেশি। কিন্তু মজুতদারির বেলায় দেখা যাচ্ছে এর উল্টো। এখানে আইনের প্রয়োগ তো আছেই, আলেমদের সক্রিয় ভূমিকা, বক্তব্য, ওয়াজ-নসিহতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। আসলে অর্থবিত্তের কাছে অনেক সময় ধর্ম মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা যখন দেখছে, মজুতদারি করে কোটি কোটি টাকা সহজে হাতানো সম্ভব, তখন তারা ধর্মকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে মজুতদারির পথেই পা বাড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো নিয়ত করে রেখেছে, ভালো ব্যবসা হলে কাবায় গিয়ে হজ করব কিংবা অমুক বড় মাদ্রাসায় দান-সদকা করে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেব। কিন্তু মানুষের জীবন-জীবিকা সংকুচিত করে হজ কিংবা সদকায় কোনো লাভ হয় না। এ সহজ বিষয়টি শয়তান মজুতদারকে ভুলিয়ে রাখে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে, সে বড় অপরাধী। জেনে রাখ, সে পাপী হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে।’ (মুসলিম : ১৬০৫)।
মজুতদারি ঘৃণ্যতর অপরাধ : সর্বসাধারণের কষ্ট ও ক্ষতি হয়, এমনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আটকে রাখাই হলো মজুতদারি। এর ফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হয়, দৈনন্দিন জীবনে খাবারের চাহিদা মেটাতে মানুষ হিমশিম খায়, অর্থনৈতিক হয়রানির শিকার হয় এবং সব শ্রেণির মানুষ খাদ্য কষ্টে ভোগে। এ জন্য ইসলামি শরিয়ত মজুতদারিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মজুতদারি করা মানব সম্প্রদায়ের ওপর এমন একটি জুলুম, যার কারণে আল্লাহতায়ালা মজুতদারদের মহামারি ও দরিদ্রতায় নিক্ষেপ করেন। তাই রাসুল (সা.) মজুতদারদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে, তবে আল্লাহতায়ালা তার ওপর মহামারি ও দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫৫)।