অল্পে তুষ্টি আনে জীবনের স্বস্তি
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকাকে অল্পে তুষ্টি বলে। (মাশারিকুল আনওয়ার : ২/১৮৭)। ইমাম সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘অল্পে তুষ্টির অর্থ হলো, অপর্যাপ্ত বিষয়ে তুষ্ট থাকা, অপ্রাপ্ত জিনিস পাওয়ার লোভ পরিত্যাগ করা এবং যা আছে, তা নিয়েই প্রাচুর্যবোধ করা।’ (মুজামু মাকালিদিল উলুম : ২০৫, ২১৭)। অল্পে তুষ্ট জীবনই প্রকৃত সুখের জীবন। ইসলাম মানুষকে সেই সুখী জীবন গঠনে উৎসাহিত করে। কেননা, সম্পদের প্রতি মানুষের যে অস্বাভাবিক আকর্ষণ রয়েছে, তা মানুষকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু যারা লোভের মুখে লাগাম টেনে স্বভাবগত এ রিপু শক্তিকে জয় করতে পারে এবং নিজের যা আছে, তা নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকতে পারে, তাদের জন্য দুনিয়াটা হয়ে যায় সুখের নীড়। মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা.)-কে অল্পে তুষ্টির নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আমরা তাদের ধনিক শ্রেণিকে যে বিলাসোপকরণগুলো দান করেছি, তুমি সেদিকে চোখ তুলে তাকাবে না। আর তাদের ব্যাপারে তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না। ঈমানদারের জন্য তুমি তোমার বাহুকে অবনত রাখো।’ (সুরা হিজর : ৮৮)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এ আয়াতে মানুষকে অন্যের ধন-সম্পদের প্রতি লোভ করতে নিষেধ করা হয়েছে।’ (তাফসিরে তাবারি : ১৭/১৪১)।
অল্পে তুষ্টি দৃঢ় ঈমানের পরিচায়ক : অল্পে তুষ্ট থাকা বান্দার ঈমানি দৃঢ়তার পরিচায়ক। আল্লাহ ও তাঁর নির্ধারিত সিদ্ধান্তের ওপর চূড়ান্ত বিশ্বাস ছাড়া কেউ স্বল্প জীবিকায় তুষ্ট থাকতে পারে না। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আল্লাহ তোমাকে যা থেকে সতর্ক করেছেন, তা থেকে সতর্ক থাকো। মানুষ তোমাকে যে ব্যাপারে (দরিদ্রতা) ভয় দেখায়, সে ব্যাপারে আল্লাহই তোমার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই তোমার দুর্বল ঈমানের অন্যতম লক্ষণ হলো- আল্লাহর কাছে যা আছে, তার চেয়ে তোমার উপার্জিত জিনিসের ওপর তুমি বেশি নির্ভর করো।’ (আল কানাআতু ওয়াত তাআফফুফ : ৫০)।
অল্পে তুষ্টি পবিত্র জীবন লাভের মাধ্যম : অল্পে তুষ্ট থাকার মাধ্যমে পবিত্র জীবন লাভ করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মোমিন অবস্থায় যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাকে তার কৃতকর্ম অপেক্ষা উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব।’ (সুরা নাহল : ৯৭)। এ আয়াতে ঈমান ও নেক আমলের পার্থিব পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আর সেটা হলো, পবিত্র জীবন। আলী (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে এ আয়াতে ‘পবিত্র জীবন’ বলতে ‘অল্পে তুষ্ট জীবন’ বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে কুরতুবি : ১০/১৭৪)। মুহাম্মদ আলী সাবুনি (রহ.) বলেন, এ আয়াতে আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘আমি দুনিয়াতে তাকে অল্পে তুষ্টি, হালাল রিজিক এবং নেক আমল সম্পাদন করার তৌফিক দানের মাধ্যমে পবিত্র জীবন দান করব।’ (সাফওয়াতুত তাফাসির : ২/১৩১)।
অল্পে তুষ্টি সফলতার সোপান : সমাজের বড় বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা প্রমুখ লোকদের আমরা সফল ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। কিন্তু প্রকৃত সফলতার ভীত প্রোথিত থাকে ইসলাম ও অল্পে তুষ্টির মাঝে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সফলকাম সেই ব্যক্তি, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাকে প্রয়োজন মাফিক রিজিক দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে অল্পে তুষ্টি দান করেছেন।’ (মুসলিম : ১০৫৪)।
আল্লাহ ও মানুষের ভালোবাসা হাসিল হয় : অল্পে তুষ্টি এমন একটি আধ্যাত্মিক সম্পদ, যা অর্জন করলে আল্লাহ ও মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায়। সাহল ইবনে সাদ আস সাদি (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি কাজের আদেশ দিন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষও আমাকে ভালোবাসবে।’ (তিরমিজি : ২৩৪৯)। রাসুল (সা.) বললেন, ‘দুনিয়াবিমুখ হয়ে যাও, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন।
আর মানুষের কাছে যা আছে, তার প্রতি লোভ কোরো না, তাহলে লোকেরা তোমাকে ভালোবাসবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১০২)। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘যতদিন তুমি মানুষের সম্পদে আসক্ত না হবে, ততদিন তুমি মানুষের কাছে সম্মানিত থাকবে এবং তারা তোমাকে সম্মান করবে। কিন্তু যখন তুমি তাদের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবে, তারা তোমাকে ছোট মনে করবে, তোমার কথা অপছন্দ করবে এবং তোমার প্রতি তাদের ঘৃণা তৈরি হবে।’
(আয যুহদ : ২১৬)। আইয়ুব আস সাখতিয়ানি (রহ.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি দুটি গুণ অর্জন না করা পর্যন্ত মহান হতে পারে না- মানুষের সম্পদ থেকে নির্মোহ থাকা এবং অন্যের অনাকাঙ্খিত আচরণ ক্ষমা করে দেওয়া।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/২০৫)।
অন্তরের ধনাঢ্যতা বাড়ে যখন : মানুষ কখনও অর্থ-সম্পদের মাধ্যমে সুখী হতে পারে না; বরং অর্থ-সম্পদকে সুখের একটি উপাদান বলা যেতে পারে মাত্র। কেননা, সমাজে অনেক বিত্তশালী লোক আছে, তাদের অনেক অর্থ-সম্পদ থাকার পরেও অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের দরিদ্র বানিয়েছে। আবার এমন গরিব মানুষ আছে, তাকদিরে বণ্টিত রিজিক পেয়েই যে পরিতুষ্ট। আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হৃদয় নিয়ে সে সুখে-শান্তিতে দিন গোজরান করে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সম্পদের আধিক্য প্রকৃত ধনাঢ্যতা নয়; বরং প্রকৃত ধনাঢ্যতা হলো অন্তরের ধনাঢ্যতা।’ (বোখারি : ৬৪৪৬)। এ কারণেই আবু হুরায়রা (রা.)-কে উপদেশ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘তোমার তাকদিরে আল্লাহ যা বণ্টন করে রেখেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকবে, তাহলে মানুষের মাঝে সর্বাপেক্ষা ধনী হতে পারবে।’ (তিরমিজি : ২৩০৫)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম মানাবি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাকদিরের নির্ধারিত রিজিক পেয়ে তুষ্ট থাকে, সে কখনও মানুষের সম্পদের দিকে প্রলুব্ধ হয় না। ফলে সে অভাবমুক্ত থাকে এবং অন্তরের দিক থেকে ধনী হয়ে ওঠে।’ (আত তাইসির বি শারহিল জামিইস সাগির : ১/২৭)। সুতরাং বান্দা অল্পে তুষ্ট থাকলে, আল্লাহ তার হৃদয়কে ধনী ও অভাবমুক্ত করে দেন। মানুষের হৃদয় তার দেহের রাজধানী। এ হৃদয়ে ঈমান ও অল্পে তুষ্টির বসবাস। অন্তর অল্পে তুষ্ট হয়ে গেলে, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও আল্লাহমুখী ও অন্যের অমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। যেমন আবু হাতেম (রহ.) বলেন, ‘অল্পে তুষ্টি হৃদয়ে বিরাজ করে। যার অন্তর অভাবমুক্ত হয়ে যায়, তার দুই হাতও অভাবমুক্ত হয়ে যায়। আর যার অন্তর দরিদ্র হয়ে যায়, তার ধনাঢ্যতা তাকে কোনো উপকার করতে পারে না। আর যে ব্যক্তি অল্পে তুষ্ট থাকে, সে কখনও (তাকদিরের প্রতি) অসন্তুষ্ট হয় না। সে নিশ্চিন্ত ও প্রশান্ত চিত্তে জীবন নির্বাহ করে।’ (রওজাতুল উকালা : ১৫১)।
বান্দার সম্মান ও মর্যাদা বেড়ে যায় : পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয় হলো, মান-সম্মান। সমাজের বুকে সবাই সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত হতে চায়। জীবনে অন্যের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও স্নেহের ফল্গুধারায় সিক্ত হতে চায়। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার কোশেশ করে। মর্যাদা পাওয়ার লোভে মানুষ কখনও কখনও অমানুষের মতো কাজ করে ফেলে। দুনিয়াদার লোকেরা পার্থিব সম্মান পাওয়ার বাসনা নিয়ে এত কিছু করলেও মোমিন বান্দারা আল্লাহর আনুগত্যেই মর্যাদা তালাশ করে। পরমুখাপেক্ষিতা ও অল্পে তুষ্টির গুণ অর্জন করে তারা নিজেদের সম্মানকে ঊর্ধ্বগামী করে তোলে। মহান আল্লাহ আমাদের অহির মাধ্যমে সম্মানিত ও মর্যাদামণ্ডিত জীবন লাভের সূত্র শিখিয়েছেন। সাহল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, একবার জিবরাইল (আ.) এসে রাসুল (সা.)-কে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! মোমিনের সম্মান বৃদ্ধি পায় কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে। আর মানুষের সম্পদ থেকে নির্মোহ থাকার মাধ্যমে তার ইজ্জত বেড়ে যায়।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম : ৭৯২১)।
আল্লাহর শোকরগোজার বান্দা হওয়ার সৌভাগ্য : আল্লাহর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা, মানব সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আল্লাহতায়ালা কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় মানব জাতিকে তাঁর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, দ্বীনের বুনিয়াদ দুটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তিশীল। তা হলো- জিকির ও কৃতজ্ঞতা আদায়। কেননা, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আর আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : ২/১৫২)। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো, অল্পে তুষ্ট থাকা। (আল ফাওয়ায়েদ : ১২৮)।
রিজিকে বরকত লাভ হয় : রিজিকে বরকত লাভের অন্যতম উপায় হলো, অধিক পাওয়ার বল্গাহীন আকাঙ্ক্ষা দূর করে হৃদয় জমিনে অল্পে তুষ্টির চারা রোপণ করা। অল্পে তুষ্ট ব্যক্তির আয়-রোজগারে আল্লাহ সীমাহীন বরকত নাজিল করেন। হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে কিছু চাইলাম। তিনি আমাকে দিলেন। আবার চাইলাম। তিনি আমাকে দিলেন। আবার চাইলাম। তিনি আমাকে দিলেন। তারপর বললেন, ‘হে হাকিম! এ সম্পদ শ্যামল সদৃশ। যে ব্যক্তি প্রশস্ত অন্তরে (লোভ ছাড়া) তা গ্রহণ করে, তার জন্য তা বরকতময় হয়। আর যে ব্যক্তি অন্তরের লোভসহ তা গ্রহণ করে, তার জন্য তা বরকতময় করা হয় না। যেন সে এমন ব্যক্তির মতো, যে খায় কিন্তু তার ক্ষুধা মেটে না। ওপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম।’ হাকিম (রা.) বলেন, আমি বললাম, ‘যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার পর মৃত্যু পর্যন্ত হাত পেতে আমি কাউকে সামান্যতমও ক্ষতিগ্রস্ত করব না।’ (বোখারি : ১৪৭২)। ইমাম তিবি (রহ.) বলেন, ‘যারা লোভের মুখে লাগাম টেনে হারাম পথ বর্জন করে হালাল পথে উপার্জন করে এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকে, আল্লাহ তাদের জীবনে বরকত দান করেন।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৪/১৩১০)।