সৃষ্টির সেরা, সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, নবীকুল শিরোমণি, বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, পথহারা পথিকের পথপ্রদর্শক, ক্ষণজন্মা এক মহাপুরুষ, সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারক প্রিয়নবী (সা.)। গোটা পৃথিবী যখন গুম-খুন, জিনা-ব্যাভিচার, হত্যা, লুণ্ঠন আর অন্ধবিশ্বাসের মূর্খতায় আচ্ছন্ন, ঠিক সে মুহূর্তে আগমন ঘটে মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সা.)-এর। তিনি ছিলেন একজন মহান সংস্কারক। তার মোবারক হাতের পরশে অল্পদিনেই পাল্টে যায় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সূক্ষ্ম ধর্মীয় অনুভূতিহীন আরব্য জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা। তিনি এ সময় মূর্খ, মেষপালক, সভ্যতাণ্ডবিবর্জিত আরববিশ্বে যে অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেন, তা পরবর্তীতে আধুনিক বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের কাছে আদর্শ হয়ে আছে। তিনি একজন যোগ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক, প্রশাসনিক উন্নয়ন করে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কায়েম করেন একটি উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
সম্পদের মালিকানা : অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে ইসলাম অর্থসম্পদণ্ডসম্পর্কিত প্রাচীন ও গতানুগতিক ধারার পুঁজিবাদী চিন্তাধারার মধ্যে আমূল পরিবর্তন সাধন করে।
আবহমানকাল ধরে ধনসম্পদকেই মানুষ মনে করে আসছে সবচেয়ে মূল্যবান এবং একমাত্র কাম্য বস্তু। কিন্তু ইসলাম ঘোষণা দেয়, এ সম্পদের একমাত্র মালিক হলেন মহান রাব্বুল আলামিন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, তার সবকিছু আল্লাহর জন্যই, আল্লাহর মালিকানাধীন।’ ইসলাম আরো বলে, অর্থসম্পদ মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য, তবে তা কখনও মানুষের একমাত্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে না। তবে ইসলাম সমাজতান্ত্রের ন্যায় ব্যক্তি মালিকানাকেও অস্বীকার করে না। ইসলাম ব্যক্তিকে অর্থ উপার্জনে দিয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। তবে তা অবশ্যই হতে হবে ইসলামের নির্দেশিত পথ-পন্থায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ কোরো না। তবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসা ছাড়া।’ (সুরা নিসা : ২৯)।
রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স : ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর অন্যতম একটি হলো, জাকাত। যা আদায় করা প্রত্যেক বৃত্তশালী ব্যক্তির ওপর আবশ্যকীয় কর্তব্য। এ জাকাত হলো সমাজের অর্থনৈতিক বৈষাম্য দূর করার অন্যতম হাতিয়ার। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ সদকা ফরজ করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে গরিবদের মাঝে বণ্টন করা হবে।’ (বোখারি)। একইসঙ্গে ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের আরো কয়েকটি অন্যতম উৎস হলো, গনিমত, ফাই; যা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর তাদের পরিত্যক্ত যাবতীয় ধন-সম্পদ বিজয়ী ইসলামি রাষ্ট্রের করতলগত হয়। আরও আছে খারাজ ও উশর বা ভূমিকর; যা রাষ্ট্রীয় কর হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে থাকা ভূমি থেকে বছরের কোনো এক সময় নেয়া হয়। আর রাষ্ট্রীয় আয়সমূহের অন্যতম আরেকটি হলো জিজিয়া; যা ইসলামি রাষ্ট্রে নিরাপত্তা নিয়ে বসবাসকারী নাগরিকদের থেকে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নেয়া হয়। যা তাদের নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যয় করা হয়।
বাইতুল মাল : জাহেলি যুগে আরবে কোনো রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল না। আরবে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বাইতুল মাল নির্মাণ করেন রাসুল (সা.)। যা আরবদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের অন্যতম সোপান হিসেবে ভূমিকা রাখে। এখান থেকে রাষ্ট্রের ও অসহায় মানুষদের যাবতীয় প্রয়োজনে অর্থ ব্যয় করা হতো। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে যার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
সুদমুক্ত অর্থনীতি : সুদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় আজকের বিশ্বে বিরাজ করছে অস্থিরতা, ধনী-গরিবের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি। কারণ, সুদভিত্তিক সমাজে দুনিয়ার সব সম্পদ গুটিকয়েক লোকের হাতে কুক্ষিগত থাকে এবং সমাজের অপর প্রান্তে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। ক্ষমতা ও অবৈধ সম্পদের নেশায় মানুষ থাকে মত্ত। তখনকার আরব্য সমাজও ছিল না এর ব্যতিক্রম। ফলে মহান আল্লাহ ঘোষণা করলেন, ‘আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন, আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।
অবৈধ উপার্জন নিষিদ্ধকরণ : ইসলাম এসে সমাজ থেকে সব অবৈধ উপার্জন পথ বন্ধ করে দেয় চিরতরে। সারাজাহানের নিয়ন্ত্রক মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’ (সুরা নিসা : ২৯)। অন্যায়ভাবে উপার্জনের অন্যতম একটি হলো, খাদ্য গুদামজাতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দেয়া। যারা এহেন অপকর্মে লিপ্ত, তাদের ব্যাপারে মহানবী (সা.) কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধিকল্পে খাদ্যবস্তু জমা করে রাখে, সে পাপী বা অন্যায়কারী।’ (মুসলিম ও সুনানে আবি দাউদ)। যারা ওজনে ফাঁকি দেয়, তাদের ব্যাপারে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা ওজনে কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১)। সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের নিকৃষ্টতম পদ্ধতি ভিক্ষাবৃত্তিকেও করেছে ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ। মহানবী (সা.) ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করে বলেন, ‘রশি নিয়ে বনে গিয়ে এক বোঝা কাঠ আহরণ করা এবং তা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা ভিক্ষা করা থেকে উত্তম।’ (সুনানে নাসাঈ)।
সৎপথে উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ : মানুষকে অসৎপথে উপার্জনে বাঁধা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি ইসলাম, বরং বাঁধা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৎপথে হালাল উপার্জনের প্রতিও উদ্বুদ্ধ করেছে। মহানবী (সা.) জীবিকা উপার্জনকে এবং সম্পদ অর্জনকে শরিয়তের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত সম্পদই হচ্ছে সর্বোত্তম সম্পদ।’
(মুসলিম)। তিনি আরো বলেন, ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর হাশর হবে নবী, সিদ্দিক ও শহিদদের সঙ্গে।’ (তিরমিজি)। মহানবী (সা.) এভাবে বহু বাণীর মাধ্যমে জীবিকা ও ব্যবসার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে গেছেন, যা আজও সবার জন্য হয়ে আছে উত্তম আদর্শ। মহানবী (সা.) আরো ঘোষণা করেছেন, ‘ব্যবসায়ীমাত্রই কেয়ামতের দিন অপরাধী হিসেবে পুনরুত্থিত হবে। তবে তারা নয়, যাদের কাজে আল্লাহভীতি ছিল, ন্যায় ও সত্যবাদিতার গুণ ছিল।’ (তিরমিজি)।