সুস্থতা আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত। এই নেয়ামত তখনই উপলব্ধি করি, যখন আমরা অসুস্থ হই। সুস্থ ও অসুস্থ মানুষ কখনও সমান হতে পারে না। একজন সুস্থ-সবল মানুষ যে কোনো কাজ যত সুন্দর ও নিখুঁতভাবে করতে পারে, একজন অসুস্থ মানুষ তা কখনও পারে না। এছাড়া ইহকালীন ও পরকালীন সব ধরনের কাজের জন্যই একটি সুস্থ শরীর ও মন জরুরি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে শক্তিশালী মোমিন দুর্বল মোমিনের চেয়ে অধিক উত্তম ও প্রিয়তর।’ (মুসলিম : ২৬৬৪)।
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের আগে গনিমত মনে কর। তা হলো- বার্ধ্যকের আগে যৌবনকালকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে প্রাচুর্যকে, ব্যস্ততার আগে অবসর সময়কে আর মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (শুয়াবুল ঈমান : ৯৭৬৭)। এ হাদিস দুটির মাধ্যমে যে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট, তা হলো- মানবজীবনে সুস্থতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সুস্থতা পাঁচটি মূল্যবান বিষয়ের একটি। এজন্য সুস্থ থাকতে হলে দৈনন্দিন অনেক বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে, যার অন্যতম হলো খাবার।
ইবাদতের জন্য শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা : বর্তমান সমাজে মানুষ না খাওয়ার চেয়ে বেশি খেয়েই নানা রোগবালাই ও আকস্মিক মৃত্যু ডেকে আনছে। এর অন্যতম কারণ হলো, খাবারের ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা কম। তাই প্রতিনিয়ত আমরা নিজেদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। শরীরের ওপর জুলুম করছি অপরিমিত এবং ভেজাল ও ফরমালিনযুক্ত খাবার খেয়ে। কেননা, আমরা যা খাই, তার অধিকাংশই ভেজাল ও ত্রুটিযুক্ত। বাজারের ফলমূল, তরিতরকারি, মাছ-মাংসসহ অনেক খাবারেই এখন দেদারসে ‘ফরমালিন’ নামের বিষ মেশানো হয়। এমনকি পানি আর দুধেও মেশানো হয় ভেজাল। স্বাস্থ্য যদি ভালো না থাকে, তাহলে আমরা ঠিকমতো কাজকর্ম এবং ইবাদত-বন্দেগি করতে পারব না। এ জন্য ইসলামে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কেননা, আল্লাহতায়ালা মানুষকে একমাত্র তাঁরই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর ইবাদতের জন্য শারীরিক শক্তি ও সুস্থতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
দামে সস্তায় রোগের বস্তা : বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন ফলের মৌসুম চলছে। বাংলাদেশের পরিচিত ও প্রধান ফল যেমন- আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, তরমুজ, পেয়ারা ইত্যাদি পাকতে শুরু করেছে। তা ছাড়া মানুষের জীবনযাত্রার মান এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত। ফলে স্বভাবতই দিন দিন বাড়ছে ফলের চাহিদা। আর এ চাহিদাকে পুঁজি করে ফলসহ বিভিন্ন খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন। বাজার-ফুটপাতগুলো ছেয়ে গেছে ভেজাল ফলে। গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষ দামে সস্তা পেয়ে সেসব ফল কিনছেন দেদারসে। বিশেষ করে, বর্তমানের উল্লেখযোগ্য ফল আম ও লিচুতে ফরমালিন বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। আম কাটলে ভেতরে দেখা যায় কালো, স্বাদণ্ডঘ্রাণ কিছুই নেই। আবার ভেতরে দেখা যায় বেশিরভাগই পচা। এই আম খেলে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যারা এসব ফল ও খাদ্যপণ্য ক্রয় করেন, তাদের অনেকেই জানেন যে, এগুলো কার্বাইড দিয়ে পাকানো। কিন্তু এরপরও মানুষ এগুলো কিনে নিজে খাচ্ছে, পরিবার ও সন্তানদের খাওয়াচ্ছে। কারণ, সবারই মৌসুমি এসব ফল খাওয়ার চাহিদা থাকে। তবে কেউ কেউ এসব না জেনেই কিনে থাকে, আবার অনেকে অর্থের অভাবে বাধ্য হয়ে ক্রয় করে।
ফরমালিনে রয়েছে মরণঘাতক রোগ : গাছপাকা ফলে দূর থেকে ঘ্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে গাছপাকা ফলের সন্ধান পাওয়াই কঠিন। অপরিপক্ব ও কাঁচা ফল পেড়ে পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পাকানো হয়। বেশিরভাগ ফলেই ব্যবহার করা হয় ফরমালিন, কার্বাইড, স্প্রে ইত্যাদি। মৌসুমি ফল লিচু, আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস, আপেল, আঙুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি ফলে মেশানো হচ্ছে এসব মরণঘাতি কেমিক্যাল।
তবে লিচু ও আম বাগানেই কেমিক্যাল মিশিয়ে সরবরাহ করা হয়। কলা কাটা থেকে বাজারে আনা পর্যন্ত দেয়া হয় বিষ। কলাগুলো বাজারে প্রবেশের আগে পাইকাররা আরেক দফা স্প্রে দিয়ে কীটনাশক মেশায়। এ ছাড়া স্প্রের মাধ্যমে মার্শাল, হিলডন, রাইজার, বাসুডিন, কার্বাইডসহ আরও অনেক ধরনের ওষুধও ছিটানো হয়। এসব বিষাক্ত উপাদান মেশানোর কারণে মানবদেহের হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুস, ব্লাডার (মূত্রথলি) ক্যান্সার, টিউমার, উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ মরণঘাতক রোগ বাসা বাঁধছে। এছাড়া স্যাকারিন মেশানো ফল খেলে অস্থিরতা, মাথা ও পেশিতে ব্যথা অনুভূত হওয়া, হাত-পা কাঁপা, হাঁটাচলার ধরন পাল্টে যাওয়া, কিডনি নষ্ট হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ ফল বা যে কোনো খাবারে ভেজাল মেশানো ইসলামে নিষিদ্ধ ও চরমভাবে নিন্দিত। এছাড়া রাষ্ট্র ও সামাজিকভাবেও এটা অনৈতিক ও গর্হিত কাজ। কারণ, এতে প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, ভেজাল মিশ্রণ, মানুষকে কষ্ট দেয়া এবং শারীরিকভাবে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ইত্যাদি বহু পাপ জড়িয়ে আছে।
ফলে ফরমালিন ও ইসলামের নির্দেশনা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা অসদুপায় অবলম্বন করে পরস্পরের ধনসম্পদ ভক্ষণ করো না।’ (সুরা নিসা : ২৯)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে বিক্রি করছ?’ তখন সে তাকে এ সম্পর্কে জানাল। এরই মধ্যে নবীজি (সা.) এ মর্মে অহিপ্রাপ্ত হলেন যে, আপনি আপনার হাত শস্যের স্তূপের ভেতরে ঢোকান। তিনি স্তূপের ভেতরে তার হাত ঢুকিয়ে অনুভব করলেন, এর ভেতরের অংশ ভেজা। তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৫২)। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। একজন মুসলমানের জন্য তার ভাইয়ের কাছে কোনো ত্রুটিপূর্ণ পণ্য বিক্রয়ের সময় পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করা পর্যন্ত তা বিক্রি করা বৈধ নয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪৬)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি সংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে, তাকে বরকত দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি অসংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে, সে এমন ব্যক্তির ন্যায়, যে আহার করে কিন্তু তৃপ্ত হয় না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৯৯৫)।
ব্যবসায় নবীজির আদর্শ অনুসরণ করা কাম্য : ইসলাম ব্যবসাকে হালাল করেছে, আর সুদকে হারাম করেছে। পেশা হিসেবে ব্যবসা করার ব্যাপারে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। শুধু তাণ্ডই নয়, প্রিয়নবী (সা.) নিজেই একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসায় তার যে দূরদর্শিতা ছিল, সে বিষয়ে একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর জ্ঞাত হওয়া ও বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো জরুরি। ইসলামে ব্যবসার উদ্দেশ্য শুধু পার্থিব জীবনে ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়া নয়, বরং এর মাধ্যমে পরকালীন জীবনের সফলতা অর্জনও এর অন্যতম লক্ষ্য। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের যে নির্দেশনা রয়েছে, তাতে ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যা শপথ, শঠতা, অবৈধ পণ্য কেনাবেচা, ভালো ও খারাপ পণ্যের মিশ্রণের মাধ্যমে অনৈতিক ব্যবসার কোনো স্থান নেই। তা ছাড়া অবৈধ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে কেউ প্রতারণা, ধোঁকাবাজি কিংবা অমানবিক কোনো উপায়-উপকরণের আশ্রয় নেয়ার বিষয়ে সবিশেষ ভীতি প্রদর্শন করেছে। মূলত সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতা- এ তিনের সমন্বয়ে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাবতীয় বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। অতএব, ব্যবসায়ীদের সেসব নীতিমালা ও বিধিবিধান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। অবৈধ ও প্রতারণামূলক ব্যবসা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।