কোনো এক জ্ঞানী বলেছেন, ‘মৃত্যুমুখে পতিত ব্যক্তি যখন কিছুটা হুঁশে থাকে, তখনই মানুষের সবচেয়ে ভালো বুঝ আসার সময়। তখন সে পুরো মাত্রায় সজাগ থাকে। সীমাহীন অস্থির থাকে। জীবনে হেলায় হারানো সময়ের জন্য পরিতাপ করতে থাকে। সে আশা করতে থাকে, হায়! তাকে যদি ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হতো! তাহলে যেসব আমল ছুটে গেছে, তা ভালোভাবে করে নিত, সত্যিকার তওবা করত।’
মৃত্যুর বাস্তবতা : মারা যাওয়ার পর জীবনের সব সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। পরকালের প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ হয়। সেখানকার সবকিছু জানতে পারে। বুঝতে পারে, পৃথিবীতে তারা যে নেয়ামতের মাঝে ছিল, তার শোকর করেছে কি-না; পৃথিবীতে তাদের যে সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তার যথাযথ ব্যবহার করেছে কি-না। তারা ভূপৃষ্ঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছে, এখন মাটির নিচে শুয়ে আছে। পৃথিবীতে তাদের একটা অস্তিত্ব ছিল, এখন সেই অস্তিত্বের সমাধি ঘটেছে। আমলই তাদের একমাত্র সম্পদ। তারা এমন দেশের অভিযাত্রী, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। মৃতরা পৃথিবী ছেড়েছে। তারা জান্নাত দেখেছে, জাহান্নাম দেখেছে, ফেরেশতাদের দেখেছে। ইহ-পরকালের প্রকৃত বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছে। দৃঢ়ভাবে জেনেছে, তারা আলমে বরযখে (কবরের জগতে) আছে। কেয়ামতে তাদের আবার উঠানো হবে। সেদিন সবাই রবের সামনে দাঁড়াবে। প্রত্যেক মৃতব্যক্তিই আশা করবে, তাকে যেন পৃথিবীতে ফেরৎ পাঠানো হয়; নেককার হলেও, বদকার হলেও। নেককাররা ফেরৎ আসতে চাইবে, যেন আরও বেশি নেক আমল করতে পারে। কারণ, তারা নেক আমলের কী মর্যাদা ও পুরস্কার, তা দেখেছে। আর বদকাররা ভুল সংশোধনের জন্য আসতে চাইবে; যেন কৃত গোনাহের জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে পারে।
জীবিতদের আকাঙ্ক্ষাসমূহ : মৃতদের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার আগে জীবিতদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। কারণ, তুলনা-প্রতিতুলনার মাধ্যমেই প্রকৃত বাস্তবতা ফুটে ওঠে। এ পৃথিবীতে যারা বেঁচে আছে, তাদের নানা আশা-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। গরিব চায় ধনী হতে। ধনী চায় তাকে আরো সম্পদ দান করা হোক, লাভ হোক সুদীর্ঘ জীবন। মুসাফির চায় বাড়ি ফিরে আসতে। অসুস্থ চায় সুস্থ হতে। বন্ধ্যা চায় সন্তানসম্ভবা হতে। অবিবাহিত চায় বিয়ে করতে। একটা ভালো চাকরি, সুন্দরী স্ত্রী, দামি গাড়ি, সুবিশাল বাড়ি, সামাজিক অবস্থান, অঢেল ধনসম্পদ, একটু পর্যটন, হাসি-আনন্দময় জীবন- এ যেন সবারই কমন চাওয়া। এটাই দুনিয়াবাসীর পরিচয়। যার কম আছে, সে তুষ্ট থাকে না। যার আছে, তার যা আছে, তাতে পেট ভরে না। আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন অন্তহীন সমুদ্র।
মৃত্যুর পর মৃতরা কী চায় : রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মৃতব্যক্তিই অনুতপ্ত হবে।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তা কীভাবে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যদি নেককার হয়, তাহলে বেশি নেক আমল করে না আসার জন্য অনুতপ্ত হবে। আর বদকার হলে কামনা করবে, হায়! তার যদি মৃত্যু না হতো। যারা নেককার, তাদের জানাজার খাটিয়া যখন কাঁধে তোলা হয়, তারা বলতে থাকে, জলদি করো। জলদি করো। আর বদকার হলে বলে, হায় আফসোস! তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আরও পরে নাও। আরও পরে নাও। তার এ আওয়াজ মানুষ ছাড়া সবকিছুতেই শুনতে পাবে। মানুষ এ আওয়াজ শুনলে বেঁহুশ হয়ে যেত।’ (বোখারি)। নেককারদের যখন কবরে প্রবেশ করানো হবে, তারা কবরের নাজ-নেয়ামত দেখবে, আলো দেখবে, প্রশস্ততা দেখবে; তারা কামনা করবে, যেন দ্রুতই কেয়ামত হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদেরকে যখন বলা হবে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো; তারা বলবে, আল্লাহ আমাকে যেভাবে ক্ষমা করেছেন ও যে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন, হায় আমার জাতি যদি এটা জানতে পারত!’ (সুরা ইয়াসিন : ২৬-২৭)।
শহিদের তামান্না : শহিদের জন্য তো জান্নাতে অনেক উঁচু স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক নাজ-নেয়ামত। তারপরও সে আকাঙ্ক্ষা করবে, তাকে যেন পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়; সে আবার জিহাদ করবে। বারবার আল্লাহর রাস্তায় শাহাদতের গৌরব লাভ করবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে প্রবেশের পর কেউই আর পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে না। তবে শহিদই একমাত্র ব্যতিক্রম। সে কামনা করবে, যেন তাকে পৃথিবীতে ফেরৎ পাঠানো হয়; যেন সে বারবার আল্লাহর পথে শাহাদত বরণ করতে পারে। কারণ, সে এর সুউচ্চ মর্যাদা প্রত্যক্ষ করেছে।’ (বোখারি)।
পাপাচারী মৃতদের কামনা : দুনিয়াতে যারা ভুল-ত্রুটি করে এসেছে, তাদেরও অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকবে। আল্লাহতায়ালা তাদের সম্পর্কে বলেন, ‘সে বলবে, হে আল্লাহ! আমাকে ফিরিয়ে নিন। হয়তো আমি নেক আমল করব।’ (সুরা মোমিনুন : ৯৯-১০০)। তিনি আরও বলেন, ‘(তারা প্রার্থনা করবে) হে আল্লাহ! আমরা দেখেছি, শুনেছি। আমাদের ফিরিয়ে নিন। আমরা নেক আমল করব। অবশ্যই আমরা দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনকারী হব।’ (সুরা সাজদা : ১২)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘(বদকার বলবে) হায় আমার এ জীবনের জন্য যদি কিছু করে আসতাম!’ (সুরা ফজর : ২৪)। তিনি আরও বলেন, ‘(পাপী ব্যক্তি বলবে) আমাকে যদি আবার ফিরে যাওয়ার একটা সুযোগ দেওয়া হতো, আমি সৎকর্মশীলদের একজন হতাম।’ (সুরা যুমার : ৫৮)। রাসুল (সা.) একবার কোনো এক কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটি কার কবর?’ সাহাবিরা বললেন, ‘অমুকের।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তার কাছে এখন দুই রাকাত নামাজ পৃথিবীর সবকিছু থেকে মূল্যবান।’ (তাবারানি)।
কেউ কেউ পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে দান-সদকা করার জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মৃত্যু আসার আগেই আল্লাহ তোমাদের যা দান করেছেন, তা থেকে খরচ করো। কারণ, (পরে) বলবে, হে আমার রব! আমাকে আর কিছুদিন সুযোগ দিলে আমি দান করতাম ও সৎকর্মশীদের একজন হতাম।’ (সুরা মোনাফিকুন : ১০)। হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘মৃত ব্যক্তিরা কবরে গিয়ে সবচেয় বেশি যেটি কামনা করবে, তা হলো- এক মুহূর্তের জীবন। যাতে সে পুনরায় তওবা করতে পারে; যেসব নেক আমল ছুটে গেছে, সেগুলো করে নিতে পারে। অথচ দুনিয়াবাসী জীবনে হেলায় নষ্ট করছে। উদাসীনতায় জীবন কেটে যাচ্ছে তাদের। পাপাচারে নিমগ্ন থাকছে সদা সর্বদা।’
দুনিয়াবাসীর কিছু বৈধ কামনা : দুনিয়াবাসীর কিছু বৈধ কামনা-বাসনা আছে। নেককার স্ত্রী, পবিত্র উত্তসূরি, হালাল রিজিক, সুস্থ জীবন ইত্যাদি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(আমার বান্দা তারাই) যারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদের নয়নজুড়ানো স্ত্রী-সন্তান দান করুন। আর মুত্তাকিদের জন্য একজন নেতা নির্বাচন করুন।’ (সুরা ফোরকান : ৭৪)। তিনি আরও বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায়ও কল্যাণ দান করুন, আখেরাতেও। আর আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে হেফাজত করুন।’ (সুরা বাকারা : ২০১)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈর্ষা করলে দুই ব্যক্তির ওপর করা যায়; একজন সে, যাকে কোরআনের জ্ঞান দান করা হয়েছে। দিনরাত সে যার হক আদায় করে। আরেকজন হলো, যাকে অঢেল সম্পদ দান করা হয়েছে, যা থেকে সে অহরহ দান করতে থাকে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
অনুবাদ : মুইনুল ইসলাম