ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সামাজিক উন্নয়নে ক্যাশ ওয়াকফ

আব্দুল্লাহ মাসুম
সামাজিক উন্নয়নে ক্যাশ ওয়াকফ

বর্তমানে দারিদ্র্যতা একটি মৌলিক সমস্যা। বিশেষত কোভিড ১৯-এ চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। নব্বই দশকের পর ২০২০ সালে মধ্যবিত্ত অস্বাভাবিকহারে নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনী ২,১৫৩ জন লোক দরিদ্রতম ৪৬০ কোটি লোকের মোট অর্থের চেয়েও বেশি অর্থ নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে জানিয়েছে ‘অক্সফাম’। বিশ্বে অতি গরিব জনসংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এ দেশের ২ কোটি ২৯ লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে। দারিদ্র বিমোচনে নানাজন নানা কথা বলছেন। কেউ কেউ আবার সুদি ক্ষুদ্রঋণের মতো ভয়াবহ পরামর্শও দিচ্ছেন। বাস্তবিক অর্থে দারিদ্র বিমোচনে সুদমুক্ত ভারসাম্য অর্থনীতির বিকল্প নেই। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। ‘ক্যাশ ওয়াকফ’ স্বেচ্ছাসেবী অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম। এর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে অস্বাভাবিক সফলতা অর্জন করা সম্ভব।

ওয়াকফ কী : মালিকানাধীন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মালিকানাসুলভ কোনো আচরণ না করার ভিত্তিতে দেওয়াকে ওয়াকফ বলে। যেমন বিক্রি করা, ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা ইত্যাদি। বরং মূল সংরক্ষণ করে এর উপকারিতা ও আমদানি বিশেষ কল্যাণমূলক খাতে (যে খাতের কথা ওয়াকফকারী বলবে) ব্যয় করা হবে। যেমন- একটা ফ্ল্যাট ওয়াকফ করার অর্থ হলো, তা সংরক্ষণ করা হবে এবং তাতে গরিবদেরকে থাকতে দেওয়া হবে অথবা ভাড়া দিয়ে এর আয় গরিবদের মাঝে বণ্টন করা হবে।

ওয়াকফ ও সাধারণ দান : বাহ্যত মনে হয়, সাধারণ দান ও ওয়াকফ একই। উভয় ক্ষেত্রে দান করা হয়। তবে বাস্তবে এ দুটির মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ওয়াকফে মূল অক্ষুণ্ণ রেখে শুধু বস্তুর উপকারিতা দান করা হয়, অপরদিকে দানে মূলও দান করে দেওয়া হয়। ওয়াকফে উপযোগিতা ও উপকারিতা চলমান থাকে, অপরদিকে দান সাধারণত অস্থায়ী হয়। ওয়াকফের ক্ষেত্র বিস্তৃত। এর উপকারভোগী কেবল দরিদ্র শ্রেণিই নয়, অপরদিকে দানের ক্ষেত্র সাধারণত অপরিসর। এর উপকারভোগী সাধারণত দরিদ্র শ্রেণি হয়ে থাকে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ওয়াকফের প্রভাব সূদুর প্রসারী, অপরদিকে দানের প্রভাব তেমন নয়।

ওয়াকফের মর্যাদা : ইসলামের দৃষ্টিতে ওয়াকফ ‘সদকায়ে জারিয়া’ তথা চলমান দানের অন্তর্ভুক্ত। মৃত্যুর পরও ওয়াকিফের ওয়াকফ মানবতার কল্যাণে অব্যাহত থাকে। সদকায়ে জারিয়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘মানুষের মৃত্যুর পর তিনটি আমল ছাড়া তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়- ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. যে ইলম দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, ৩. যে নেক সন্তান তার জন্য দোয়া করে।’ (আল কুশাইরি : ১৬৩১)। ইমাম নববী (রহ.) এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘সদকায়ে জারিয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ওয়াকফ। হাদিসটি ওয়াকফের বৈধতার ওপর একটি মৌলিক দলিল। পাশাপাশি ওয়াকফের গুরুত্ব ও তার বিশাল সওয়াবের প্রমাণও এতে রয়েছে।’ (নববি : ২/৮৫)।

ওয়াকফ যুগে যুগে : ওয়াকফের ধারণাটি সুপ্রাচীন। পূর্ববর্তী নবীগণও ওয়াফফ করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ও তাঁর সাহাবিগণ ব্যাপকভাবে ওয়াকফ করেছেন। সাহাবিগণ তাদের মূল্যবান সম্পদ ওয়াকফের জন্য নির্বাচন করতেন। মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে তৎকালীন ব্যাপক ওয়াকফরীতি বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। সে সময়কার বহুমাত্রিক ওয়াকফের কিছু নমুনা হলো-

মসজিদ ওয়াকফ : রাসুল (সা.)-এর হিজরতের পর মসজিদে কোবা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামে ওয়াকফ আরম্ভ হয়। (আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ বিল মিনাহিল মুহাম্মাদিয়্যাহ : ১/৩০৮)। এটি ছিলো ইসলামি যুগের সর্বপ্রথম ওয়াকফ। আর দ্বিতীয় ওয়াকফ ছিলো মসজিদে নববী। যা রাসুল (সা.) নিজে জমি কিনে ওয়াকফ করেছিলেন এবং তাতে মসজিদ নির্মাণ করলেন। (উমদাতুল কারি : ৪/১৭৭)।

রূমা কূপ সুপেয় পানির জন্য ওয়াকফ : মদিনায় মিষ্টি পানির জন্য এক ইহুদির বিখ্যাত একটি কূপ ছিল রূমা। মুসলমানরা সহজে সেখান থেকে পানি নিতে পারত না। তাদেরকে পানি কিনতে হতো। এ ব্যাপারটি রাসুল (সা.) লক্ষ্য করলেন। একদিন বললেন, ‘কে আছো, যে রূমা কূপটি ক্রয় করবে এবং তা থেকে অন্যান্য মুসলমানদের বালতির সঙ্গে নিজের বালতি নামানোরও সুযোগ লাভ করবে (ওয়াকফ করবে)। বিনিময়ে এর চেয়ে উত্তম বদলা জান্নাতে গ্রহণ করবে?’ এ ঘোষণার পর হজরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) কূপটি ক্রয় করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। (তিরমিজি : ৩৭০৩)।

ফসলের বাগান ওয়াকফ : রাসুল (সা.) মদিনায় তাঁর সাতটি বাগান বনী আবদুল মুত্তালিব এবং বনী হাশেমের জন্য ওয়াকফ করে গেছেন। (সুনানে বায়হাকি : ৬/১৬০)।

ভূমি ওয়াকফ : ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আবাদি জমি ওয়াকফ করেন হজরত ওমর (রা.)। তিনি খায়বারের সুমাগ নামক এক খণ্ড জমি লাভ করেছিলেন। রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! আমি এমন এক খণ্ড জমি লাভ করেছি, যার মতো মূল্যবান জমি এর আগে পাইনি। আপনি আমাকে এ জমির ব্যাপারে কী আদেশ করবেন?’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি এটি দান করতে চাচ্ছি। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি মূল ভূমিটা এভাবে ওয়াকফ করে দাও যে, তা বিক্রি বা দান করা যাবে না। তাতে উত্তরাধিকারও সাব্যস্ত হবে না। তবে তার ফসল খরচ করা হবে।’ (বোখারি : ২৭৬৪)।

পশু ওয়াকফ : রাসুল (সা.)-এর যুগে এক ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একটি উট ওয়াকফ করলো। তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি এটি হাজিদের জন্য ব্যবহার করো।’ (আল মাবসুত : ৩/১০)।

ওয়াকফ ও ক্যাশ ওয়াকফ : ওয়াকফ হলো, সাধারণ ওয়াকফ। এতে স্থাবর-অস্থাবর সবকিছু অন্তর্ভুক্ত। জমি যেমন ওয়াকফ করা যায়, প্রচলনের ভিত্তিতে বইপত্রও ওয়াকফ করা যায়। অপরদিকে ক্যাশ ওয়াকফ হলো, বিশেষ ওয়াকফ। এতে শুধু মুদ্রার ওয়াকফ অন্তর্ভুক্ত; অন্য কিছু নয়। যদিও ব্যাপক অর্থে ওয়াকফের মধ্যে ক্যাশ ওয়াকফও চলে আসে। তবে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করতে সাম্প্রতিক সময়ে ‘ক্যাশ ওয়াকফ’ আলাদা করে বলা হয়। ইসলামি ইতিহাসে তা ‘ওয়াকফুন নুকুদ’ নামে পরিচিত।

ক্যাশ ওয়াকফ কি : প্রাচীন ফিকহে ক্যাশ ওয়াকফের বিশেষ কোনো পরিচিতি নেই। বর্তমান সময়ের ফকিহগণ এর বিভিন্ন একাডেমিক পরিচয় পেশ করেছেন। ড. মুহাম্মদ সালেম বাখদার এ প্রসঙ্গে তার পিএইচডি গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘ক্যাশ ওয়াকফ হলো, নগদ টাকা ওয়াকফ করা হবে করজে হাসানা অথবা শরয়ি দৃষ্টিতে বৈধ বিনিয়োগে কাজে লাগানোর জন্য। এরপর প্রাপ্ত মুনাফা ওয়াকিফের শর্তানুযায়ী কিংবা কল্যাণমূলক কোনো খাতে ব্যয় করা হবে।’ (তাময়িলু ওয়াকফিন নুকুদ : ৪৭)।

ক্যাশ ওয়াকফের বৈধতা : প্রাচীন হাম্বলি ও শাফেয়ি ফিকহে ক্যাশ ওয়াকফ বৈধতার বিপক্ষে মতামত থাকলেও বর্তমান সময়ে মৌলিকভাবে প্রায় সকল ফকিহ এর বৈধতার ব্যাপারে একমত। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ইসলামি ফিকহ একাডেমির ১৯তম সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তাতে একটি সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্যাশ ওয়াকফকে সুকুক ও শেয়ার ক্রয়েও বিনিয়োগ করা যাবে। ওয়াকফকারী স্পষ্ট কিছু না বললে ক্রয়কৃত সুকুক ও শেয়ার সরাসরি ওয়াকফ হয়ে যাবে না। বরং সেটি লাভে বিক্রয়ও করা যাবে। ওয়াকফকৃত ক্যাশ মূল ওয়াকফ হিসেবে বাকি থাকবে। (মাজাল্লাতু মাজমাউ ফিকহিল ইসলামি : ১৫, ৩/৫২৭)। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শরিয়াহ স্ট্যান্ডার্ড প্রণেতা প্রতিষ্ঠান এ্যাওফি (অঅঙওঋও) তাদের ওয়াকফ বিষয়ক ৩৩নং শরিয়াহ স্ট্যান্ডার্ডেও ক্যাশ ওয়াকফকে ব্যাপকভাবে অনুমোদন করেছেন।

দারিদ্র্য বিমোচনে প্রয়োগ : ক্যাশ ওয়াকফের মূল কথা হলো, ওয়াকফকৃত মূল ক্যাশ পরিমাণে অক্ষুণ্ণ থাকবে। ওয়াকফের নীতি অনুযায়ী এর মূল অক্ষুণ্ণ রেখে উপকার গ্রহণ করা হবে। উপকার গ্রহণের প্রসিদ্ধ পদ্ধতি দুটি- ১. করজে হাসানা সেবা প্রদান, ২. বিনিয়োগ প্রদান।

সাধারণত করজে হাসানা অস্থায়ী হয়। দেওয়ার পর শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ক্যাশ ওয়াকফের অধীনে করজে হাসানা সেবা চালু করতে পারলে তা হবে দীর্ঘস্থায়ী। এর মাধ্যমে সমাজের বহু ক্ষেত্রে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব। সুদি ক্ষুদ্রঋণের বিপরীতে এটি একটি উত্তম বিকল্প হতে পারে। এর পদ্ধতি হলো, ক্যাশ টাকা ওয়াকফ করা হবে। এরপর মূল টাকা কাউকে করজে হাসানা হিসেবে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে ওয়াকফকারী শুধু বাস্তব সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে। আমাদের সমাজে এর নানামুখী প্রয়োগ সম্ভব। যেমন-

আবাসিক হলে ক্যাশ ওয়াকফ : প্রতিটি আবাসিক ছাত্র/ছাত্রী হোস্টেলে এই সেবা চালু করা যেতে পারে। বাড়ি যাওয়ার সময় প্রায়ই ছাত্রদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না। কারও থেকে ধার করতে হয়। এ ক্ষেত্রে হোস্টেলের স্থায়ী বিশ্বস্থ কোনো দায়িত্বশীলের অধীনে ক্যাশ ওয়াকফ চালু করা যেতে পারে। ছাত্ররা যে যার মতো করে প্রতি মাসে কিছু টাকা ক্যাশ ওয়াকফ করবে। এরপর সেই টাকা থেকে তাদেরকে করজে হাসানা দেওয়া হবে। পরীক্ষার ফি থেকে শুরু করে খাবারের টাকাও তারা এখান থেকে করজে হাসানা হিসেবে নিতে পারবে।

পারিবারিক ক্যাশ ওয়াকফ : প্রতিটি পরিবারে গড়ে উঠতে পারে ক্ষুদ্র ক্যাশ ওয়াকফ প্রকল্প। পরিবারের সদস্যরা সাধ্যমতো ক্যাশ ওয়াকফ করবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা সংরক্ষিত থাকবে। সেখান থেকে পরিবারের সদস্যগণ প্রয়োজনমতো করজে হাসানা গ্রহণ করতে পারবে।

কর্মস্থলে ক্যাশ ওয়াকফ : প্রতিটি অফিসে ক্যাশ ওয়াকফ রীতি গড়ে তোলা সম্ভব। অফিসের কর্মকর্তাগণ নানা প্রয়োজনে সুদি ঋণ গ্রহণ করেন। অফিসে ক্যাশ ওয়াকফের ব্যবস্থা থাকলে সুদি ঋণের বিপরীতে সহজেই করজে হাসানা পাওয়া যাবে।

সামাজিক ক্যাশ ওয়াকফ : প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষদের স্বতন্ত্র সমিতি থাকে। এসব সমিতি থেকে সদস্যগণ সুদে ঋণ গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে ক্যাশ ওয়াকফ সুন্দর সমাধান। নামমাত্র সার্ভিস চার্জে সদস্যগণ করজে হাসানা পেয়ে যাবেন। দারিদ্র বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ ধারণা দুর্দান্ত সফলতা নিয়ে আসবে, ইনশাআল্লাহ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত