আয়-রোজগার ও ইসলাম

মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামের প্রথম পর্যায়ের ফরজ আমলগুলোর পরই হালাল রিজিক অন্বেষণ করার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল রুজি সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অনিবার্য।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ১০/৩৭৭)। তাই ইসলামি অর্থনীতির স্বীকৃত নীতি হলো, ‘প্রয়োজনীয় ইলম অন্বেষণ করা যেমন ফরজ, তেমনি প্রয়োজনীয় সম্পদ উপার্জন ও অনুসন্ধান করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক।’ (কিতাবুল কাসব : ৭১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ইসলামের প্রাথমিক মৌলিক ফরজ আমলগুলোর পরই দ্বিতীয় পর্যায়ের ফরজ আমল।’ (কানযুল উম্মাল : ৯২৩১)।

হালাল উপার্জন ও দুনিয়ার প্রতি আসক্তি : হালাল উপার্জন করা দ্বিতীয় ফরজ হলেও দুনিয়ার প্রতি আসক্তি নিষিদ্ধ। হালাল উপার্জন হচ্ছে; কিন্তু দুনিয়ার প্রতি আসক্তি হচ্ছে না, এর উদাহরণ হলো, নামাজের সময় দোকান বন্ধ করে মসজিদে যাওয়া। কিন্তু ব্যবসায় এত ডুবে থাকা যে, নামাজ পড়ারও ফুরসত নেই; তাহলে তা দুনিয়ার প্রতি আসক্তি। সুতরাং হালাল উপার্জন করা ফরজ, তবে দুনিয়ার প্রতি আসক্তি নিষিদ্ধ। এ জন্যই ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘ব্যবসা করা ফরজে কেফায়া। কারণ এ ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র চলতে পারে না। তবে সম্পদের আসক্তি নিষিদ্ধ।’ (খুতুবাতে হাকিমুল উম্মত : ৮/১৯৭)।

রিজিক অন্বেষণে করণীয় : রিজিক অন্বেষণে ছয়টি নির্দেশনা মেনে চলা আবশ্যক। যথা-

১. নিয়ত শুদ্ধ রাখা : নিয়ত বিশুদ্ধ হলে সাধারণ কাজও অসাধারণ হয়ে ওঠে। ঠাণ্ডা পানি পান করার প্রয়োজন। রাসুল (সা.) ঠাণ্ডা পানি পছন্দ করতেন, তাই পান করছি। এমন সামান্য কয়েক সেকেন্ডের নিয়ত সাধারণ পানি পানকে অসাধারণ করে তুলবে। তেমনি ব্যবসা বা চাকরির ক্ষেত্রে নিয়ত করা, আমার ওপর আমার ও আমার অধীনস্থদের যে হক রয়েছে, তা পূরণের জন্য ও আমার কাজের মাধ্যমে মানুষকে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সর্বোপরি এসব কাজের মাধ্যমে রাসুল (সা.)-এর সুন্নত ও রিজিক অন্বেষণের ফরজ আমল আদায়ের নিয়তে ব্যবসা বা চাকরি করছি। এ নিয়তের পর কোনো আয় না হলেও পরকালের রোজগার হয়ে যাবে।

২. ইসলামের বিধানমতে রিজিক অন্বেষণ করা : রিজিক অন্বেষণ করতে হবে ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী। সুতরাং সম্পদ ও উপার্জন সংক্রান্ত ইসলামের যেসব নির্দেশনা রয়েছে, সেসব অনুসরণ করতে হবে। সম্পদের জাকাত ও সদকা আদায় করতে হবে। উপার্জন করতে হবে হালাল পন্থায়। হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এরই মধ্যে হারাম উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকলে, সত্ত্বর হালাল চাকরি বা উপার্জনের পথ খুঁজে নিতে হবে। বেকার লোকের চাকরি খোঁজার মতো চাকরি খুঁজতে হবে। চলনসই কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা হলেই হারাম চাকরি ত্যাগ করতে হবে। চাকরি বা ব্যবসা যদিও হালাল, তবে এতে নিজের অজান্তেই অনেক লুকায়িত হারাম উপার্জন থেকে যায়। এসব লুকায়িত হারাম থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি বলেন, ‘যদি কেউ সর্বদা চিন্তা করে, তার উপার্জনে যেন এক টাকাও হারাম না ঢোকে। তাহলে বিশ্বাস রাখুন, ওই লোক যদি জীবনে কোনো নফল নামাজও না পড়ে, নিয়মিত জিকির-তাসবিও আদায় না করে, বরং নিজেকে হারাম উপার্জন থেকে রক্ষা করে কবর পর্যন্ত চলে যায়, তাহলে ইনশাআল্লাহ সে সোজা জান্নাতে যাবে। আর যদি এমন হয়, হালাল-হারামের কোনো ফিকির নেই। তবে তাহাজ্জুদ মিস হয় না। জিকির-তাসবি নিয়মিত হয়, তাহলে এসব নফল ইবাদত তাকে হারাম উপার্জনের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।’ (ইসলাহি খুতুবাত : ১০/১৭৪)।

৩. হালাল পেশাকে গুরুত্ব প্রদান : হালাল রিজিক আল্লাহর বিশেষ দান। তাই এর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা যাবে না।

যখন কারও রিজিক কোনো হালাল পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, তখন সেটি গুরুত্ব দেয়া উচিত। চাই সে পেশা যে রকমই হোক না কেনো। নিজ পেশাকে কখনও ছোট করে দেখা যাবে না। আল্লাহর দানকে বিনা কারণে ত্যাগ করা ঠিক নয়।

তবে যদি নিজ থেকেই ওই পেশা বন্ধ না হয়ে যায় বা তা বহাল রাখা বিভিন্ন পেরেশানির কারণ হয় বা শরিয়তসম্মত কোনো কারণ থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে পেশা পরিবর্তন করা যাবে। বিনা কারণে পরিবর্তন বা পেশার ব্যাপারে গাফেল থাকা ঠিক নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যাকে কোনো বস্তুর মাধ্যমে রিজিক প্রদান করা হয়, সে যেন তা আঁকড়ে ধরে রাখে।’ (কানজুল উম্মাল : ৯২৮৬)।

৪. নিজের প্রাপ্তির ওপর সন্তুষ্ট থাকা : আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য যে রিজিক বরাদ্দ রেখেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কে আমার থেকে ৫টি বিশেষ নসিহত গ্রহণ করবে, এরপর সে অনুযায়ী নিজে আমল করবে বা যে আমল করবে, তাকে শেখাবে?’ আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, ‘আমি প্রস্তুত হে আল্লাহর রাসুল (সা.)!’ রাসুল (সা.) আবু হুরায়রা (রা.)-এর হাত ধরে গুণে গুণে ৫টি উপদেশ দিলেন। এর অন্যতম একটি হলো, ‘তুমি হারাম বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকো, তাহলে তুমি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অধিক ইবাদতগোজার বান্দা হয়ে যাবে। আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যে রিজিক রেখেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকো, তাহলে তুমি সকলের মাঝে সবচেয়ে অধিক ধনী হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ২৩০৫)। মূলত ধনী সেই, যে অন্যের প্রতি মুখাপেক্ষী হয় না। যার প্রচুর সম্পদ থাকে, সে অন্যের প্রতি মুহতাজ হয় না। তাই তাকে ধনী বলা হয়। এটি তখনই অর্জন হয়, যখন আমার কাছে যা আছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকার গুণ অর্জন হবে। হাদিসের ভাষায় একে ‘কানাআত’ বলা হয়।

যখন এ গুণ অর্জন হবে, তখনই সে ধনী। সুতরাং কারও কাছে যদি অঢেল সম্পদ থাকে, তারপরও সে অন্যের সম্পদের প্রতি তাকিয়ে থাকে, অমুখাপেক্ষী হয় না, তাহলে সে ধনী নয়। পক্ষান্তরে যার অর্থ-কড়ি কম। তবে নিজের প্রাপ্তির ওপর সন্তুষ্ট থাকে। কারও কাছে হাত পাতে না। তাহলে সে প্রকৃত ধনী। রাসুল (সা.) এ গুণ অর্জনের জন্য দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে রিজিক দান করেছ, এর ওপর আমাকে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত করে দাও। এতে বরকত নসিব করো। আমি যা পাইনি বা হারিয়ে ফেলেছি, এমন সব কিছুর পরিবর্তে আমার জন্য যা কল্যাণকর, তা দান করো।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম : ১/৪৫৫)।

৫. আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া : আল্লাহতায়ালা আমার জন্য যে মানের রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। তার সিদ্ধান্ত সহাস্য বদনে মেনে নেয়া। অন্যেরটা দেখে কষ্ট না লাগা। দুনিয়াতে কারোরই সব আকাঙ্ক্ষা-বাসনা পূরণ হয় না। যত বড় ধনী হোক, তারও কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়। তাহলে এখন পথ দুটি- হয় সারা জীবন আফসোস করতে হবে, কেনো অমুক শখটি পূর্ণ হলো না; নয়তো আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তবে চেষ্টা না করে তাকদিরকে দোষ দেয়া যাবে না। চেষ্টা করতে হবে। তারপরও না মিললে সেটার ব্যাপারেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মোমিন হবে না, যাবত সে আল্লাহর তাকদির ও ফয়সালার ওপর ঈমান আনবে। সে তাকদির ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। বিশ্বাস করতে হবে, যা সে পেয়েছে, তা হাত ছাড়া হওয়ার ছিল না। যা পায়নি, তা পাওয়ার ছিল না।’ (তিরমিজি : ২১৪৪)।

৬. রিজিক অন্বেষণে ভারসাম্যতা বজায় রাখা : বৈধ পন্থায় রিজিক অন্বেষণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। এমনকি ব্যবসার পরিধিও বৃদ্ধি করাও নিষিদ্ধ নয়। নিজের প্রাপ্তির ওপর সন্তুষ্ট থাকার অর্থ এই নয়, সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কোনো চেষ্টা করা ঠিক নয়; বরং যা আছে, তার ওপরই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বরং এর আসল অর্থ হলো, যত ইচ্ছে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করা যাবে। সম্পদ যত খুশি উপার্জন করা যাবে। তবে পূর্বোক্ত নির্দেশনাগুলো অনুসরণের পাশাপাশি এটিও খেয়াল রাখা জরুরি, তা যেন ভারসাম্য পন্থায় হয়। এমন যেন না হয়, দুনিয়া কামানো নিজের ওপর সওয়ার হয়ে গেছে। এখন দিনরাত শুধু ব্যবসার চিন্তা। পরিবারের হক আদায় করারও সুযোগ হয় না। এত বেশি ব্যতিব্যস্ত যে, কোনো দ্বীনি মাহফিল বা হালকায় যাওয়ারও সুযোগ হয় না। ঘুমেও স্বপ্ন দেখে, আকাশের তারারা একে অপরের সঙ্গে ব্যবসা করছে। নামাজেও ব্যবসার চিন্তা পেয়ে বসে। রিজিক অন্বেষণের এমন চেষ্টা কাম্য নয়। যদিও তা হালাল পথে হোক না কেনো।

লেখক : সিএসএএ, অ্যাওফি, বাহরাইন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি লি.