ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মানবসেবা হোক জীবনের লক্ষ্য

আবদুল্লাহ নোমান
মানবসেবা হোক জীবনের লক্ষ্য

পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে মানবেতর জীবন যাপনকারী হাজারো বনি আদম নানা দুর্যোগ-বিপর্যয়ে আক্রান্ত। হতদরিদ্র মানুষগুলো দুঃখে-শোকে, বেদনায়-যন্ত্রনায়, হতাশায়-অস্থিরতায় ব্যথিত মনে দিনযাপন করে। অসহায় মা নিজের কথা ভুলে জীর্ণ-শীর্ণ কংকালসার ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বার্ধক্যের জরাজীর্ণতায়, ক্ষুধার যন্ত্রণায়, রোগের তীব্রতায় এবং আর্থিক অসচ্ছলতায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জীবনের চরাই-উতরাই পাড়ি দেয় অসংখ্য মানুষ। তাদের বিক্ষত মনের বুকফাটা আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। আক্ষেপের বিষয় হলো, মানবিকতার চাণক্যপূর্ণ বাণী দানকারী তথাকথিত মানবতাবাদী সুশীল সমাজ তাদের পাশে নেই। দানে-বিসর্জনে এগিয়ে এসে তাদের মলিন চেহারায় হাসি ফোটায় না কেউ। তাদের বুভুক্ষ মুখে এক টুকরো রুটি বা দু’মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে না। অথচ আমাদের আবির্ভাবই হয়েছে মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। মানবতার কল্যাণে তোমাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)।

মানবসেবা নবীজির আদর্শ : মানবতার চিরকল্যাণকামী পরম বিশ্বস্ত বন্ধু প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) জীবনের পরতে পরতে আমাদের শিখিয়েছেন মানবসেবার আলোকোজ্জল আদর্শ ও প্রাণীর সেবার বিভাময় দর্শন। বঞ্চিত-আক্রান্ত-পীড়িতদের জন্য তার হৃদয়ে প্রোথিত ছিল গভীরতম মমতা, নিখাদ ভালোবাসা ও পরম সহানুভূতি। বিপদাপদে ও দুঃখ-দুর্দশায় তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতেন হৃদয়ের ডানা বিছিয়ে। রাসুল (সা.) অহির প্রথম সাক্ষাতে যখন শংকিত ও কম্পিত হয়ে পড়েন, তখন তার সহধর্মিণী খাদিজাতুল কোবরা (রা.) তাকে সান্ত¡না দিয়ে এ বলে সাহস যোগালেন, ‘আল্লাহতায়ালা আপনাকে কখনও অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি তো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখেন, অসহায়দের ভার বহন করেন, অসহায়কে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন, অতিথিকে আপ্যায়ন করেন এবং সত্যের পথে বিপদগ্রস্তদের সহযোগিতা করেন।’ (বোখারি : ৩)।

সহযোগিতায় মেলে রবের সাহায্য : পার্থিব জগতে মানবজীবন সব সময় সুখময় ও মধুময় হয় না। হয় না সর্বদা আনন্দঘেরা ও তৃপ্তিভরা। কখনও কুসুমাস্তীর্ণ জীবনযাত্রা হয়ে যায় কণ্টকাকীর্ণ। নির্মল হৃদয়াকাশে নেমে আসে বিষণ্ণতার কালো মেঘ। আলো ঝলমল সোনালি জীবনে ধেয়ে আসে তিমির অন্ধকার। সবকিছু হয়ে যায় ছারখার।

বন্ধ হয় দুনিয়ালোভী ধনীদের দুয়ার। স্বার্থপরতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। একসময় রক্তের আত্মীয়রাও পিছিয়ে যায়। আত্মার আত্মীয়রাও দূরে সরে যায়। অনেকেই সুখের সাগর একসঙ্গে পাড়ি দিয়ে দুঃখের সাগরে একলা ভাসিয়ে চলে যায় দূর বহুদূর।

উপকারী বন্ধুর দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়ায় না। একটু খবরও নেয় না। সান্ত¡না বাণীও শোনায় না। ধন-সম্পদের ছোঁয়া লাগা মানুষগুলো হয়ে যায় কৃপণ। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী লোকগুলো হয়ে যায় নির্দয়। তারা অভাবীদের বঞ্চিত করে দান-ধন থেকে, প্রীতি ও অনুগ্রহ থেকে। অথচ দান ও দয়ার আশায় গরিবরা দলে দলে তাদের দুয়ারে ছুটে আসে। অবশেষে মনক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে যায় কষ্টাশ্রু মুছতে মুছতে। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ঈমানদারের একটি পার্থিব কষ্ট লাঘব করবে, আল্লাহতায়ালা তার কেয়ামত দিবসের একটি কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি (লেনদেনে) কোনো অভাবী মানুষকে ছাড় দেবে, আল্লাহতায়ালা ইহ-পরকালে তাকে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)। তিনি আরও বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা দয়ালুদের ওপর দয়া করেন। যারা জমিনে বসবাস করছে, তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো; তাহলে যিনি আকাশে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি : ১৯২৪)।

নিয়ত বিশুদ্ধ হতে হবে : মোমিনের প্রতিটি কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে হতে হবে। একনিষ্ঠভাবে তাঁর রেজামন্দি লাভের জন্যই হওয়া জরুরি। ইখলাসশূন্য আমলের কোনো মূল্য নেই তাঁর কাছে। লৌকিকতাপূর্ণ আমল ভঙ্গুর এ পৃথিবীতে অনেক জমকালো দেখা গেলেও পরকালে এর কানাকড়িও দাম নেই। বিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমেই মোমিনের প্রতিটি কাজ ইবাদতে পরিণত হয়। তাই দান হতে হবে ইখলাসের ভূষণে ভূষিত, বিশুদ্ধ নিয়তের শোভায় শোভিত। অন্যথায় তা হবে অন্তঃসারশূন্য। এমনকি মানুষের বাহ বাহ অর্জন ও লোক দেখানো মনোভাবে কৃত আমল জাহান্নামে যাওয়ার কারণও বটে। (মুসলিম : ৪৮১৭)।

মানবসেবায় হতে হবে নিঃস্বার্থ : প্রজ্ঞাময়ের কী লীলা- ধন আছে তো মন নেই, মন আছে তো ধন নেই! যার মাঝে ঘটে ধন-মনের শুভমিলন, সে হয় পরম সৌভাগ্যবান। হৃদয়ে হয় যেমন সে প্রশস্ত, দানেও হয় তেমন মুক্তহস্ত। সে মানুষকে ভালোবাসে প্রাণভরে, কথা বলে হাসিমুখে, দান করে হাত খুলে। দান-সুখের উল্লাসে তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে অপার্থিব স্বর্গীয় হাসি। তার দেহজুড়ে বয়ে যায় আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার বাঁধভাঙা জোয়ার। দুঃখের কথা হলো, এখন মানুষ এগিয়ে আসে তার সাহায্যে, অদূর ভবিষ্যতে যার হতে পারে সম্পদের আখড়া এবং কড়ায়-গণ্ডায় পেয়ে যাবে উপকারের বদলা। কিন্তু যার জীবনের কিশতী মাঝ দরিয়ায় কাত হয়ে গেছে, কে জানে কখন কোথায় আছড়ে পড়ে! তলিয়ে যায় কোন অজানায় প্রবল ঝড়ে! তার থেকে মানুষ নিরাপদ দূরত্বে কেটে পড়ে। অযথা অর্থ ব্যয় মনে করে। অথচ মানবসেবা করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সাহায্য করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহর ভালোবাসায় মিসকিন, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে। (আর তাদের বলে,) আমরা তো তোমাদের খাওয়াই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আমরা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও নই।’ (সুরা দাহর : ৮-৯)।

মানবসেবায় সদকা বাক্স : আমরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত বা ঘরোয়াভাবে একটি সদকা বাক্স রাখতে পারি। এতে প্রতিদিন সাধ্যমতো খুচরা, ভাংতি এবং নোট রাখা হবে। পরিবারের সব সদস্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে সদকায় অংশ নিতে পারবে। ছোটবেলা থেকেই শিশুরা দানের প্রতি উৎসাহিত হবে। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পরহিতৈষী ও পরোপকারী হিসেবে গড়ে উঠবে। মাস শেষে টাকাগুলো গরিব-দুঃখীদের মাঝে খুব সহজে বিতরণ করা যায়। তা পেয়ে তাদের মনের অন্দরমহলে নিঃশেষ হতে পারে ভাঙনের জোয়ার, বন্ধ হতে পারে গভীর দুঃখবোধের প্লাবন। দাতার জন্য আনন্দের আতিশয্যে হৃদয়ের গভীর থেকে নির্গত দোয়া সরাসরি কড়া নাড়বে আরশে আজিমে। কেউ যদি সুখী ও নির্মল জীবনের প্রত্যাশী হয়, তবে অবশ্যই তাকে বিষণ্ণ ব্যক্তিকে প্রসন্ন করতে সচেষ্ট হতে হবে। অন্যের ভাঙা মনকে চাঙা করার আয়োজন করতে হবে। ফ্যাকাশে চেহারায় হাসির ঝিলিক ফোটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বস্তুত আমাদের কাছে যা জমা থাকবে, তা এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর আল্লাহর কাছে যা পাঠিয়ে দেব, তা পরকালীন সঞ্চয় হিসেবে জমা থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কাছে যা কিছু আছে, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে; আর আল্লাহর কাছে যা আছে, তা স্থায়ী।’ (সুরা নাহল : ৯৬)। তিনি আরো বলেন, ‘(স্মরণ রেখ) তোমরা যে কোনো সৎকর্ম নিজেদের কল্যাণার্থে সামনে (আখেরাতে) প্রেরণ করবে, আল্লাহর কাছে তা পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যে কোনো কাজ কর, আল্লাহ তা দেখছেন।’ (সুরা বাকারা : ১১০)।

লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত