একসময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তুরস্ক। ১৯২০-এর দশকে জাতীয়তাবাদী নেতা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে দেশটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিকাশ লাভ করে। তুরস্কের বেশিরভাগ অংশ এশিয়া ও কিছু অংশ ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত। একই সঙ্গে দুই মহাদেশের অংশ হওয়ায় কৃষ্ণসাগরের প্রবেশ পথের ওপর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করেছে দেশটি। ১৯৩৮ সালে কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুর পর গণতন্ত্র এবং বাজার অর্থনীতির পথে দেশটির অগ্রগতি প্রায় থমকে গিয়েছিল। সামরিক বাহিনী সংবিধানের রক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে একের পর এক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে শুরু করে। যা দেশটির ধর্মনিরপেক্ষতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সদস্যপদ লাভ করা ছিল তুরস্কের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা। ২০০৫ সালে তুরস্ককে সদস্যপদ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চললেও দেশটির গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তা স্থগিত হয়ে যায়। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ কুর্দি। তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধ্বংসের চেষ্টার অভিযোগে বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি জনগোষ্ঠী ১৯৮০ সাল থেকেই দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
পূর্বনাম : তুর্কি
বর্তমান নাম : তুর্কিয়ে (TURKIYE) প্রজাতন্ত্র।
রাজধানী : আঙ্কারা
আয়তন : ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার
জনসংখ্যা : ৮ কোটি ৪৬ লাখ
ভাষা : তার্কিশ, কুর্দি, আরবি ও জাজা
গড় আয়ু : পুরুষদের ৭৪ বছর ও নারীদের ৮০ বছর
নেতৃত্ব : বর্তমানে দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান। ২০০৩ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রথম ক্ষমতায় আসেন ইসলামপন্থি জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এরদোয়ান। টানা ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০১৪ সালে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ২০১৮ সালে আবারো নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আছেন তিনি। সমর্থকরা মনে করেন, তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে এসেছেন এরদোয়ান। অপরদিকে সমালোচকদের কাছে এরদোয়ান হলেন বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করা একজন স্বৈরাচারী শাসক।
সংবাদমাধ্যম : দেশটির রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম টিআরটি-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আছে কয়েকশ’ বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেল। অবশ্য সম্প্রচারমাধ্যম ও সংবাদপত্রগুলোতে সরকারপন্থীদের আধিপত্য বিরাজমান। সমালোচনামূলক সংবাদপত্রগুলো প্রতিনিয়ত অভিযান ও জরিমানার ঝুঁকিতে থাকে। দেশটিতে গ্রেফতারকৃত অধিকাংশ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য হওয়ার অভিযোগ তুলেছিল পুলিশ। মূলধারার মিডিয়ার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে ভিন্নমত ও বিভিন্ন খবর প্রকাশ করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হয় দেশটিতে।
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
১৪৫৩ : বাইজেন্টাইন সা¤্রাজ্যের ইতি টেনে দ্বিতীয় সুলতান মেহমেদ কনস্টানি কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) দখল করে বর্তমানে আনাতোলিয়া নামে পরিচিত এশিয়া মাইনর ও বলকান অঞ্চলজুড়ে থাকা এলাকায় অটোমান সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
১৬৮৩ : অটোমান সা¤্রাজ্য ইউরোপে বিস্তৃত হতে শুরু করলে রোমান সা¤্রাজ্যের সঙ্গে ভিয়েনা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে হারের মাধ্যমে অটোমান সা¤্রাজ্যের পতনের শুরু হয়।
১৯০৮ : তরুণ তুর্কি বিপ্লবের মাধ্যমে অটোমান সা¤্রাজ্যের দ্বিতীয় সাংবিধানিক যুগের সূচনা হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সা¤্রাজ্যটি সামরিক একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়ে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করে।
১৯১৮-২২ : অটোমান সা¤্রাজ্যের পরাজয়ে বিদেশি দখলদারিত্ব ও সুলতান শাসনের বিরুদ্ধে তুরস্কের জাতীয় আন্দোলনের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
১৯২৩ : কামাল আতাতুর্ককে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরপরই ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৩৯-৪৫ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকটা নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল তুরস্ক। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপান ও জার্মানির বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করলেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে জাতিসংঘে যোগ দেয় দেশটি।
১৯৫২ : কামাল আতাতুর্কের জোট নিরপেক্ষ নীতি ত্যাগ করে ন্যাটোতে যোগ দেয় তুরস্ক।
১৯৬০ : ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক দলের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান হয়।
১৯৬৩ : ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটি (ইইসি) বা বর্তমান ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
১৯৭৪ : তুর্কি সেনারা উত্তর সাইপ্রাস দখল করে।
১৯৮০ : সেনা অভ্যুত্থানের ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। দেশটিতে সামরিক শাসন জারি করা হয়।
১৯৮৪ : কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা অভিযানের ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কয়েক দশক ধরে চলে এ গৃহযুদ্ধ।
১৯৮৭ : ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটির (ইইসি) সদস্যপদের জন্য আবেদন করে তুরস্ক।
২০০২ : ইসলামপন্থী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে) নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়। অবশ্য সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দলটি।
২০০৩ : একে পার্টির নেতা রজব তাইয়েব এরদোয়ান পার্লামেন্টে জয়ী হন। এর কিছুদিন পরেই আবদুল্লাহ গুল পদত্যাগ করেন এবং এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
২০১১ : সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর ফলে দেশ দুটির সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী তুরস্কে আশ্রয় নেয়।
২০১৪ : দেশটিতে প্রথমবারের মতো জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এরদোয়ান।
২০১৬ : অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অভ্যুত্থানে জড়িত সন্দেহে হাজার হাজার সেনা ও বিচারককে আটক করে কর্তৃপক্ষ।
২০১৭ : গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা চালু হয়।
২০২২ : জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির তুর্কিয়ে নামকরণে অনুমোদন দেয়।