ইসলাম অর্থ-বিত্ত কুক্ষিগত করে না রেখে প্রাণ খুলে অভাবীদের মাঝে বিলিয়ে দিতে বলে। দানে-বিসর্জনে গরিব-দুঃখী ও অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর প্রতি উৎসাহিত করে। কাড়ি কাড়ি ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের তরল আমন্ত্রণ, সে তো বেঈমানদের পাতা ফাঁদ। দানে অভাবের ভয় ও সম্পদের অট্টালিকা গড়ে তোলার ঘৃণ্য নেশা নিঃসন্দেহে অভিশপ্ত শয়তানের কুমন্ত্রণা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার আদেশ করে, আর আল্লাহ তোমাদের স্বীয় মাগফিরাত ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ অতি প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : ২৬৮)। বেদনার কথা হলো- দেশি-বিদেশি বিত্তশালী ধনী মুসলমানদের অর্থ-কড়ি সঞ্চিত হয় আমাদের দাগি শত্রু ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ব্যাংকে। সুদের রক্তচোষা সেই বেঈমানরা নিজেদের ইচ্ছেমতো তা নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগ করে। ফলে মানবসেবার খোলসে তা ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম গরিব রাষ্ট্রগুলোর অজপাড়াগাঁ পর্যন্ত। মানবতার ফেরিওয়ালা ও জনদরদীর মুখোশধারী সেই মহাজনদের সুদের কিস্তি আদায় করতে গিয়ে নিভৃতে জীবন দেয় হাজারো গরিব-দুঃখী ও হতদরিদ্র বিবি তমীজনরা। কেউ বা বসতবাড়ি হারিয়ে হয় নিঃস্ব ও পথের ভিখারি। আবার কেউ দেউলিয়া হয়ে পা বাড়ায় আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপে। লজ্জাজনক ব্যাপার হলো, অসহায় গরিব মারার নরপিশাচ ঘাতক কারিগরদের জনসম্মুখে নির্লজ্জভাবে পুরস্কৃত করা হয় নোবেল দিয়ে। অতএব, এ পাথর সময়ে পাহাড় পাহাড় সোনাদানা নয়; প্রত্যেককেই নিজ নিজ অবস্থান ও সাধ্যানুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে মানবতার সেবায়। অন্যের কল্যাণ সাধন, দুস্থ ও পীড়িতজনদের সাহায্য প্রদান, নির্যাতিতদের পক্ষ গ্রহণের উদার মানসিকতাকে নবীজি (সা.) প্রমোট করেছেন এ বলে, ‘দ্বীন মানেই কল্যাণকামিতা।’ (মুসলিম : ১০০)।
অভাবীদের প্রাধান্য দেয়া ইসলামের শিক্ষা : মানবিকতার ধর্ম ইসলামের অনন্য সৌন্দর্য হলো, ইসলাম যেমন প্রীতি-সৌহার্দ্য ও হৃদ্যতার চূড়ান্ত স্তরের প্রতি মোমিনদের উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি অপর ভাইয়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রতিও উৎসাহ জোগায়। ইসলামের সূচনালগ্নে যখন মক্কার মুসলমানরা কাফেরদের সীমাহীন অত্যাচারে ভয়াবহ এক অগ্নিসময় পার করছিলেন, নিজ গোত্রের অবিচার ও নিপীড়নে সহায়-সম্পদ ত্যাগ করে স্বদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন মদিনার আনসার সাহাবিরা হাসিমুখে তাদের বরণ করেছিলেন। নিজেদের স্বার্থ ও কামনা-বাসনা দু’পায়ে দলে, হাজারো চাহিদাকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুহাজির মুসলমান ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। নিজেরা উপবাসের যন্ত্রণা ভোগ করে সামর্থের সবটুকু উজাড় করে তাদের পরিতৃপ্ত করতেন। নিজেদের প্রয়োজনের ওপর তাদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ঐতিহাসিক উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাদের সর্বোচ্চ বিসর্জন ও অপরাজেয় মনোবলের এ পরার্থপরতাময় মহৎ গুণটি মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন। বলেছেন, ‘তারা (আনসাররা) নিজেদের ওপর (মুহাজিরদের) প্রাধান্য দেয়। যদিও নিজেদের প্রয়োজন ও অভাব থাকে। যারা স্বভাবগত কার্পণ্য হতে মুক্তি লাভ করে, তারাই তো সফলকাম।’ (সুরা হাশর : ৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা জান্নাতের বিশেষ কিছু নেয়ামত উল্লেখপূর্বক এসবের অধিকারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন এ বলে, ‘(তারাই এসব নেয়ামত লাভ করবে) যারা খাবারের প্রতি নিজেদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে।’ (সুরা দাহর : ৮)।
দান হোক উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তু : অনেকের স্বভাব হচ্ছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নষ্ট, পচা ও অকেজো বস্তু দান করেই নিজেকে প্রবোধ দেয়। প্রিয় ও শখের বস্তু দান করার কল্পনাও করে না কখনও। দান-খয়রাতকে জরিমানা মনে করে। গা এড়ানোর জন্য উদ্বৃত্ত বস্তু দান করে পরম আনন্দে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। অথচ পরিপূর্ণ সওয়াব লাভ করার জন্য প্রিয় বস্তুই দান করতে হবে। এতেই ঘটবে আল্লাহর সঙ্গে প্রকৃত ভালোবাসা ও মানবতার প্রতি সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। পবিত্র কোরআনের বাণী, ‘তোমরা কস্মিনকালেও কল্যাণ (পূর্ণ সওয়াব) লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না করো। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে, আল্লাহ তা জানেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯২)। নবীজি (সা.)-এর স্নেহধন্য সাহাবায়ে কেরাম সব সময় কোরআনি বিধান বাস্তবায়নে মুখিয়ে থাকতেন। শরিয়তের হুকুম পালনে তারা ছিলেন চাতকসম অটল অবিচল। আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় ও শখের বস্তুটি দান করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, মদিনার আনসারিদের মধ্যে আবু তালহা (রা.) সবচেয়ে বেশি খেজুর বাগানের মালিক ছিলেন। মসজিদে নববির নিকটবর্তী ‘বায়রুহা’ নামক বাগানটি তার কাছে অধিক প্রিয় ছিল। রাসুল (সা.) তার বাগানে প্রবেশ করে এর সুপেয় পানি পান করতেন। আনাস (রা.) বলেন, যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হলো, ‘তোমরা যা ভালোবাস, তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনও পুণ্য লাভ করবে না’, তখন আবু তালহা রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা ভালোবাস, তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনও পুণ্য লাভ করবে না।’ আর ‘বায়রুহা’ নামক বাগানটি আমার কাছে অধিক প্রিয়। এটি আল্লাহর নামে সদকা করে দিলাম। আমি এর কল্যাণ কামনা করি এবং তা আল্লাহর কাছে আমার জন্য সঞ্চয়রূপে থাকবে। কাজেই আপনি যাকে দান করা ভালো মনে করেন, তাকে দান করুন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমাকে সাবাশ! এ হচ্ছে লাভজনক সম্পদ, এ হচ্ছে লাভজনক সম্পদ। তুমি যা বলেছ, তা শুনলাম। আমার মত হলো, তোমার আপনজনদের মধ্যে তা বণ্টন করে দাও।’ আবু তালহা (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি তাই করব।’ এরপর তিনি তার আত্মীয়-স্বজন, আপন চাচার বংশধরদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিলেন। (বোখারি : ১৪৬১)।
উপরোল্লিখিত আয়াতে প্রণিধানযোগ্য বিষয় : এক. বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ স্কলারদের মতে আয়াতের অর্থে ফরজ ও নফল উভয় প্রকার দান-খয়রাতই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দান-সদকায় পূর্ণ সওয়াব পেতে হলে সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুই দান করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! নিজেদের উপার্জন থেকে এবং যা কিছু আমি তোমাদের জন্য জমি থেকে উৎপন্ন করেছি, আল্লাহর পথে তার উত্তম বস্তু ব্যয় কর। আর মেয়ের জন্য এমন বাজে জিনিসের নিয়ত করবে না, যা প্রাপ্য হিসেবে তোমাদের দেয়া হলে তোমরাও তা কখনও গ্রহণ করবে না। তবে কোনো কারণবশত চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করলে তা ভিন্ন কথা।’ (সুরা বাকারা : ২৬৭)।
দুই. আয়াতে ‘মিম্মা’ শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে, সব প্রিয় বস্তু উজাড় করে দিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করা উদ্দেশ্য নয়; বরং যতটুকুই ব্যয় করবে, ভালো ও প্রিয় বস্তু দেখেই ব্যয় করা বাঞ্ছনীয়। তবেই পূর্ণ সওয়াব লাভ করা যাবে।
তিন. প্রিয় বস্তু ব্যয় করার অর্থ শুধু অধিক মূল্যবান বস্তু ব্যয় করা নয়; বরং নগণ্য ও স্বল্প মূল্যের বস্তুও যদি কারও দৃষ্টিতে প্রিয় হয়, সে তা দান করলেও পুরোপুরি সওয়াব লাভ করবে। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খাঁটি মনে যা দান করা হয়, তা একটি খেজুরের দানা হলেও তাতে আয়াতের বর্ণনামতে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হবে।
চার. নিঃসম্বল ও গরিব-মিসকিন যাদের মূল্যবান ও আকর্ষণীয় বস্তু নেই, নেই অঢেল ধন-সম্পদ, তারাও জিকির-আজকার তেলাওয়াত, অধিক নফল ইবাদত ইত্যাদি উপায়েও দান-সদকার এ মহাপুণ্য অর্জন করতে পারে; যা কোনো কোনো হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
পাঁচ. কোরআনের অন্য আয়াত (তথা সুরা হাশর : ৯ এবং সুরা দাহর : ৮) থেকে জানা যায়, প্রিয় বস্তু বলতে এমন জিনিস বোঝানো হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজে লাগে, হাতছাড়া হলে সে তার অভাব বোধ করে এবং যা উদ্বৃত্ত ও অকেজো নয়।
ছয়. আয়াতের শেষাংশের দ্বারা প্রতীয়মান হয়, প্রয়োজনাতিরিক্ত বস্তু ব্যয় করাও সওয়াবমুক্ত নয়। কোনো দান-খয়রাতই পুণ্যমুক্ত নয়। চাই তা প্রিয় বস্তু হোক বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। তবে দানের ক্ষেত্রে সব সময় নষ্ট, বিকৃত ও অকেজো বস্তু ব্যয় করার রীতি অবলম্বন করা মাকরুহ ও নিষিদ্ধ। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রিয় বস্তুও ব্যয় করে এবং মাঝে মাঝে প্রয়োজনাতিরিক্ত বস্তু যেমন উদ্বৃত্ত খাদ্য, পুরোনো পোশাক, ত্রুটিযুক্ত পাত্র এবং ব্যবহৃত পণ্যও দান করে, সেও অবশ্যই সওয়াবের অধিকারী হবে। সেই সঙ্গে আয়াতের শেষাংশে এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ যা ব্যয় করে, তার আসল স্বরূপ আল্লাহর অজানা নয়। সুখ্যাতি ও লোক দেখানো মনোভাব পরিহার করে তার সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে সাধ্যমতো ভালো উত্তম বস্তু দান করাই কাম্য। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন : ২/৯৩-৯৫)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম