‘রিবা’ একটি শরয়ি পরিভাষা। এর ধরন, প্রকৃতি শরিয়তে স্পষ্ট। ফকিহগণ যুগে যুগে এর তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। প্রতি যুগে যে একই পদ্ধতিতে রিবার প্রচলন ছিল, বিষয়টি এমন নয়। বিভিন্ন যুগে এর পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে। তবে শুধু পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে রিবা থেকে বের করে দেয়া হয়নি। বর্তমান যুগে ব্যাংকিং সুদের প্রচলন রয়েছে। ব্যাংকে মানুষ টাকা জমা করে। বিনিময়ে ব্যাংক তাদের সুদ প্রদান করে। আবার ব্যাংকও সেই গৃহীত টাকা অন্যদের ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করে। এভাবে এক পক্ষ থেকে সুদ গ্রহণ করে অন্য পক্ষকে সুদ পরিশোধ করা হয়। প্রচলিত ব্যাংকিং সুদের এ প্রচলন হুবহু আগে না থাকলেও রিবার মূলবিষয় তাতে আছে। তাই বর্তমান সময়ের ফকিহগণ একে স্পষ্ট ভাষায় ইসলামে নিষিদ্ধ ‘রিবা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ বিষয়ে গুটি কতক মানুষ যে ভিন্ন কথা বলতে চেয়েছেন, ব্যাংকের সুদ আর রিবা এক নয়, তা গ্রহণ করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক ফিকহ ফোরামের শরিয়া সিদ্ধান্ত : ১. আন্তর্জাতিক ইসলামি ফিকহ একাডেমি, জেদ্দা (১৪০৬ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে) একাডেমির দশম সেমিনারে সুদি ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে লেনদেন বিষয়ে যে শরয়ি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মেয়াদান্তে ঋণের ওপর অতিরিক্ত গ্রহণ করা কিংবা শুরু থেকেই অতিরিক্ত আদান-প্রদান সরাসরি হারাম রিবা।’ (রেজুলেশন : ১০-১০/২)।
২. ইসলামি ফিকহ একাডেমি, ভারত (১৪১০ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে) একাডেমির দ্বিতীয় ফিকহি সেমিনারের রেজুলেশনে স্পষ্ট ঘোষণা করেছে, ‘উপস্থিত ফকিহগণের মতে প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ রিবা।’ (এহেম ফিকহি ফয়সালা : ১৭)।
৩. ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি (Islamic Research Academy, Al Ayhar Al Sharif) মিশরের উচ্চপর্যায়ের জাতীয় শরিয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান। মিশর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তারা সমকালীন বিভিন্ন শরিয়া ইস্যুতে শরিয়া সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকে। ১৩৮৫ হিজরি মোতাবেক ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তাদের উদ্যোগে মিশরে শরিয়া স্কলারগণের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দীর্ঘ আলোচনার পর তাদের শরিয়া রেজুলেশনে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘প্রচলিত সুদি ব্যাংকিং-এ ঋণের ওপর অতিরিক্ত আদান-প্রদান রিবা। এ ক্ষেত্রে কমার্শিয়াল লোন ও প্রাইভেট লোনের মাঝে কোনো তফাৎ হবে না।’ (ফিকহুন নাওয়াজেল : ১৪৫)।
৪. ইসলামি ফিকহ একাডেমি, মক্কা সৌদি আরবের মানিটারি এজেন্সির আইন উপদেষ্টা ইবরাহিম ইবনে আবদুল্লাহ দাবি করেছিলেন, ‘প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ রিবা নয়; ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ বৈধ।’ এর ওপর উক্ত একাডেমি ১৪০৮ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এক সেমিনারের আয়োজন করে। তাতে স্পষ্ট ভাষায় ইবরাহিমের দাবিগুলো খণ্ডন করা হয়। এ বিষয়ক সম্মিলিত শরিয়া সিদ্ধান্তে তা উল্লেখ করা হয়। (সেমিনার : ১০, সিদ্ধান্ত : ৫, একাডেমির সিদ্ধান্তসমূহ : ২৪১)। এর আগে ১৪০৬ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে একাডেমি বিশ্বব্যাপী সুদি ব্যাংকিংয়ের বিস্তৃতি ও এগুলোর সঙ্গে মুসলিমদের লেনদেনবিষয়ক এক সেমিনারের আয়োজন করে। উক্ত সেমিনারের শরিয়া রেজুলেশনেও স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়, ‘ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে লেনদেন করার সুযোগ থাকলে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য সুদি ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে লেনদেন করা হারাম। চাই তা অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত কাজে হোক।’ (ফাওয়ায়িদুল বুনুক হিয়ার রিবাল হারাম : ১৩৭)।
৫. মিশরের জাতীয় ও কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা প্রধান ও মিশরের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ জাদুল হক আলী জাদুল হক (রহ.)-এর ফতোয়া। তিনি মিশরের জাতীয় দারুল ইফতার ১৪তম প্রধান মুফতি ছিলেন। তিনি তার একাধিক ফতোয়ায় স্পষ্ট বলেছেন, ‘প্রচলিত ব্যাংকে অর্থ জমা করে অতিরিক্ত আদান-প্রদান রিবা।’ (ফতোয়া : ১২৫৪, ১২৫৫)।
৬. ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কনফারেন্স ১৯৮৩ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত হয়। এর রেজুলেশনেও স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়, ‘প্রচলিত অর্থনীতিতে ইন্টারেস্ট যাকে বলা হয়, সেটি শরিয়তের দৃষ্টিতে স্পষ্ট রিবা।’ (ফাওয়ায়িদুল বুনুক হিয়ার রিবাল হারাম : ১৪৩)। ৭. আল আজহার ফতোয়া কমিটি ১৯৮৮ সালে এক ফতোয়ায় সিদ্ধান্ত দিয়েছে, ‘সুদি ব্যাংকের সরকারি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেটে অংশগ্রহণ করা বৈধ নয়। কারণ তা সুদভিত্তিক ঋণ।’ (প্রাগুক্ত : ১৪৫)।
লেখক : সিএসএএ, অ্যাওফি, বাহরাইন ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি লি.।