মানুষ সৃষ্টির সেরা ও শ্রেষ্ঠ জীব। এ শ্রেষ্ঠত্বকে অনেক সময় খামচে ধরে অভাব ও দারিদ্র। অভাব-অনটনে একদিকে যেমন বিবেক-বুদ্ধি ঢিলে হয়ে পড়ে, তেমনি ধীরে ধীরে দুর্বল হয় মনুষ্যত্ব ও মানবতা। ক্ষেত্র বিশেষে তা ধর্মকেও আক্রান্ত করে। ইসলাম মানুষকে স্বনির্ভর হতে উৎসাহ দেয়, বেকারত্ব ও অলসতাকে চরম ঘৃণাভরে দেখে। শ্রমজীবী মানুষকে সাহায্যের জন্য অন্যের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয় না। শক্তি-মেধায় কর্মক্ষম ও স্বাবলম্বী ব্যক্তি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান তথা মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে সক্ষম হয় সহজেই। সে কখনও অন্যের বোঝা হয় না। বরং কর্মে-সৃজনে বিকশিত হয়ে চারপাশকে হাসিয়ে তোলে। দানে-বিসর্জনে পাশে দাঁড়ায় দুস্থ মানবতার।
মোমিনের মর্যাদা অমুখাপেক্ষিতায় : ইসলামের অপরাজেয় কৃতিত্ব হচ্ছে, পরকালের আলোকিত পথের যেভাবে সন্ধান দেয়, তেমনি পার্থিব জীবনকে সুখময় করতেও উৎসাহিত করে। ধর্মের আলো শুধু আত্মাকেই বিমল করে না, বাইরের জীবনেও এনে দেয় প্রশান্তির স্নিগ্ধ ছোঁয়া। ইসলাম পরনির্ভরশীলতা ও বঞ্চনার জীবনকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখেনি কখনও। সাহল ইবনে সাদ (রা.) বর্ণনা করেন, জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-এর কাছে নিবেদন করলেন, ‘হে মুহাম্মদ! আপনি যতদিন খুশি পৃথিবীতে জীবনযাপন করুন, তবে একদিন আপনি মৃত্যুবরণ করবেন। আপনি যা ইচ্ছে করুন, তবে আপনি তার প্রতিদান পাবেন। আপনি যাকে খুশি ভালোবাসুন, তবে একদিন তার থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। জেনে রাখুন, মোমিন বান্দার মর্যাদা রাত্রি জাগরণে (তাহাজ্জুদে)। আর তার সম্মান মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতায়।’ (সুনানে বায়হাকি : ১০৫৪১)।
অভাবে স্বভাব নষ্ট : অভাবের কারণে মানুষ ধর্মান্তরিত হতেও কুণ্ঠিত হয় না। চিরস্থায়ী জাহান্নামকে গ্রহণ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এর বাস্তব চিত্র উত্তরবঙ্গে প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। খ্রিষ্টান মিশনারিরা সরলমনা মুসলমানদের অভাবের সুযোগ নিয়ে সাত রাজার ধনের চেয়েও মূল্যবান ঈমান হরণ করছে। হাজারো মানুষকে খ্রিষ্টান বানাচ্ছে। সেখানকার দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মুসলমানদের অবস্থা অনেকটা এমন, ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, কুফরি তখন জানালায় আহ্বান জানায়।’ অভাবের যাতাকলে নিষ্পেষিত মানুষের ঈমান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। নষ্ট হয়ে যায় স্বভাব-চরিত্র। হারিয়ে ফেলে নিজের মর্যাদা, স্বকীয়তা, ঐতিহ্য। তাই তো রাসুল (সা.) বলেন, ‘অভাব অনেক সময় কুফরির দিকে ঠেলে দেয়।’ (মুজামুল আওসাত : ৪০৪৪)।
মোমিন কারও কাছে হাত পাতবে না : ইসলামের অনুপম শিক্ষা হলো, মুসলমান শুধু আল্লাহরই মুখাপেক্ষী হবে। ছোট-বড় যে কোনো প্রয়োজনে তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করবে। রাব্বুল আলামিন ছাড়া অন্য কারও কাছে হাত পেতে নিজেকে লাঞ্ছিত করবে না। অপদস্থ করবে না নিজের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটকে। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বলেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে নয়জন, আটজন কিংবা সাতজন ছিলাম। তিনি আমাদের বললেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর রাসুলের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে না?’ অথচ আমরা মাত্রই আকাবায় বাইয়াত গ্রহণ করেছি। তাই বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা তো আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছি।’ তিনি আবার বললেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর রাসুলের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে না?’ আমরা তখন হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা তো বাইয়াত গ্রহণ করেছি। এখন আবার কীসের বাইয়াত গ্রহণ করব?’ বললেন, ‘এই মর্মে শপথ নাও, শুধু আল্লাহর ইবাদত করবে। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে। আমিরের কথা মেনে চলবে।’ তারপর তিনি নিচুস্বরে একটি গোপন কথা বললেন, ‘আর মানুষের কাছে কিছু চাইবে না।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমি সেখানে উপস্থিতিদের মধ্যে কাউকে দেখেছি, তাদের হাতের ছুরিটি পড়ে গেলেও কাউকে তুলে দিতে বলতেন না।’ (রিয়াদুস সালেহিন : ৫৩৪)।
নবীজি (সা.) যার জান্নাতের দায়িত্বশীল : মানুষ চাইবে শুধু আল্লাহর কাছেই, বান্দার কাছে নয়। হাত পাতবে শুধু রবের কাছে, মানুষের কাছে নয়। তবেই সে সমাজে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। চোখে চোখ রেখে হক কথা বলতে সক্ষম হবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে তাকে বেগ পেতে হবে না। নির্দ্বিধায় সে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে পারবে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তাই তো একবার মহানবী (সা.) বললেন, ‘কে আছ, যে আমাকে নিশ্চয়তা দেবে যে, সে অন্যের কাছে কিছু চাইবে না, তাহলে আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার হব?’ সাওবান (রা.) বললেন, ‘আমি।’ এরপর তিনি কারও কাছে কিছু চাইতেন না। (সুনানে আবি দাউদ : ১৬৪৩)।
রিজিক অনুসন্ধানে ঐশী নির্দেশ : মানুষ আল্লাহর ইবাদত যথাযথ পালন করবে, পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং স্বাবলম্বী হবে। হাত গুটিয়ে বসে না থেকে কর্মসংস্থান তৈরি করবে। সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এটাই প্রজ্ঞাময় রবের নির্দেশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নামাজ শেষ হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। আর বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : ১০)। তবে জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে আল্লাহর বিধান লংঘন করা যাবে না। নবীজি (সা.) উম্মতকে পরনির্ভর না হয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। সেই সঙ্গে হালাল উপার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা দ্বীনের (প্রথম স্তরের) ফরজগুলোর পর অন্যতম ফরজ।’ (সুনানে বায়হাকি : ১২০৩০)।
পেশাজীবী বান্দা আল্লাহর প্রিয় : নিজ হাতে রোজগার সর্বোত্তম উপার্জন। এর দ্বারা ব্যক্তি একদিকে যেমন নিজের ও অন্যের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, তেমনি হজ, জাকাত, দান-সদকা ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতেও অগ্রগামী হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।’ (বোখারি : ২০৭২)। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আখড়া। তাই শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে আপন কর্মে ব্যস্ত থেকে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ভীত মজবুত করা যায়, তেমনি নানা শয়তানি কুকীর্তি থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বেকারত্বের কলংক থেকেও মুক্তি মেলে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ঈমানদার পেশাজীবী বান্দাকে পছন্দ করেন।’ (সুনানে বায়হাকি : ১২৩৭)।
বৈধ পেশায় লজ্জা নেই : পেশা ছোট-বড় যেমনই হোক, ইসলাম প্রতিটি হালাল পেশাকে সম্মানের চোখে দেখে। পেশা ও উপার্জন পন্থায় শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি উদার। মানুষের স্বহস্তে উপার্জন সবচেয়ে উত্তম ও বরকতময় উপার্জন। একবার নবীজি (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন উপার্জন সবচেয়ে পবিত্র?’ বললেন, ‘ব্যক্তির স্বহস্তে উপার্জন এবং সব সততাপূর্ণ ব্যবসা।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭২৬৫)। আরেক হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কারও পক্ষে এক বোঝা জ্বালানি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নিয়ে আসা কারও কাছে চাওয়ার চেয়ে উত্তম। কেননা, চাইলে সে অনেক সময় দিতেও পারে, আবার নাও দিতে পারে।’ (বোখারি : ২০৭৪)।
নিজ হাতে উপার্জন নবী-রাসুলদের সুন্নত : যুগে যুগে নবী-রাসুলরাও আপন পেশায় সমুজ্জ্বল ছিলেন। ছিলেন স্বনির্ভর শ্রমনির্ভর ও প্রতিষ্ঠিত। তারা নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আদম (আ.) কৃষক ছিলেন। নুহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। ইদরিস (আ.) একজন সূচিজীবি ছিলেন। দাউদ (আ.) ছিলেন একজন বর্মনির্মাতা। মুসা (আ.) একজন রাখাল ছিলেন। ইবরাহিম (আ.) কৃষিজীবী ছিলেন। আর সালেহ (আ.) ছিলেন ব্যবসায়ী।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম : ৪১৬৫)। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয়নবী (সা.) নিজেও একসময় ছাগল চরিয়েছেন। যৌবনে তিনি খাদিজা (রা.)-এর অধীনে ব্যবসা করেছেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাহাবায়ে কেরামও শ্রমজীবী ছিলেন। আনসাররা সাধারণত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর মুহাজিররা ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম