ইসলামে সচ্ছলতার গুরুত্ব

মুইনুল ইসলাম

প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম কারও ধনাঢ্যতায় বাঁধা নয়। ভালো খেতে, ভালো পরতে, পছন্দের জিনিস দান করতে ইসলাম কখনও নিষেধ করেনি। বরং ইসলাম পবিত্র বস্তু হালাল আর অপবিত্র বস্তু হারাম করেছে। অপচয়হীন ব্যয় ও কৃপণতামুক্ত সঞ্চয়কে উদার দৃষ্টিতে দেখে। অনেক সাহাবি এমন ছিলেন, যাদের ধনাঢ্যতা, লেবাস-পোশাক ও চাল-চলনের সচ্ছলতা ছিল প্রবাদতুল্য। তা সত্ত্বেও তারা তাকওয়া-পরহেজগারির প্রতি পূর্ণ মনোযোগী ছিলেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তার ধনাঢ্যতায় সমস্যা নেই। তার জন্য সুস্থতা ধনাঢ্যতা অপেক্ষা উত্তম। হৃদয়ের সুখ উত্তম সম্পদের প্রাচুর্য থেকে আসে।’ (সুনানে বায়হাকি : ১১৮৮)।

সম্পদ সমাজের স্তম্ভ : ইসলাম সম্পদ উপার্জন ও সংরক্ষণে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। সম্পদকে আখ্যায়িত করেছে জীবনের মেরুদণ্ড ও সমাজের স্তম্ভ। আল্লাহতায়ালা সম্পদকে জীবনের ভূষণ সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের শোভা।’ (সুরা কাহফ : ৪৬)। তিনি আরো বলেন, ‘নারী-সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত ঘোড়া, গবাদিপশু ও ক্ষেত-খামারের প্রতি আকর্ষণ মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। এগুলো পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪)। আল্লাহতায়ালা পার্থিব জীবনের যেসব পবিত্র বস্তু হালাল করেছেন, যারা সেগুলো নিজেদের জন্য হারাম করে নেয়, কোরআন তাদের শক্ত ভাষায় নিন্দা করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, আল্লাহ নিজ বান্দাদের জন্য যেসব শোভাময় বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, কে তা হারাম করেছে? পার্থিব জীবনে এসব মোমিনদের জন্য। পরকালে তো বিশেষভাবে তাদেরই।’ (সুরা আরাফ : ৩২)।

দারিদ্র্য থেকে মুক্তি কামনা : যদি বৈধ পন্থায় আল্লাহর আনুগত্য লাভ ও পার্থিব জীবনে সংকট মোকাবিলার উদ্দেশ্যে সম্পদ উপার্জন করা হয়, তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, দারিদ্র্য দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটায়।

তাই রাসুল (সা.) দারিদ্র্য ও ঋণগ্রস্ততা থেকে আল্লাহর কাছে মুক্তি চাইতেন। বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কুফরি ও দারিদ্র্য থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫০৯০)। সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম এ বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের দুনিয়াবিরাগ করুন, তবে প্রাচুর্যও দিন। দুনিয়াকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তার প্রতি আমাদের আকৃষ্ট করে তুলবেন না।’ (মাজলিসান মিন আমালি আবিল হাসান বিন বুশরান : ১১)।

স্বচ্ছলতায় আসে ধর্মীয় ব্যাপকতা : আবু বকর (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি চল্লিশ হাজার দিরহামের মালিক ছিলেন। তিনি এসব অর্থ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন। এমন সাতজন ব্যক্তিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন, ইসলাম গ্রহণের কারণে যাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। তারা হলেন- বেলাল, আমের ইবনে ফুহায়রা, যুনায়রা, নাহদিয়া ও তার কন্যা, উম্মে উবাইস ও বনু মুআম্মালের এক দাসী।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)। তাই একবার রাসুল (সা.) বললেন, ‘আবু বকরের সম্পদ দ্বারা আমি যতটা উপকৃত হয়েছি, এতটা উপকৃত কারও সম্পদ দ্বারা হইনি।’ আবু বকর (রা.) এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি ও আমার সম্পদ কি আপনার জন্য নই?’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)।

ধনাঢ্যতায় মানবসেবার সুযোগ : এক ইহুদির রুমা নামক একটি কূপ ছিল। সে মুসলমানদের কাছে তার পানি বিক্রি করত। রাসুল (সা.) বললেন, ‘কে আছ রুমা কূপটি কিনে মুসলমানদের জন্য দান করবে, আর সেও অন্য মুসলমানদের মতো একজন হয়ে সেখান থেকে পানি তুলবে? তাহলে বিনিময়ে তাকে জান্নাতে একটি মনোরম ঘর দেয়া হবে।’ ওসমান (রা.) ঘোষণাটি শুনে ইহুদির কাছে গেলেন। দাম জিজ্ঞেস করলেন কূপের। ইহুদি পুরোটা বিক্রি করতে চাইল না। তিনি বারো হাজার দিরহাম দিয়ে তার অর্ধেকটা কিনে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিলেন। এরপর ইহুদিকে বললেন, ‘তুমি চাইলে কূপের দুটো প্রান্ত আমার জন্য নির্ধারণ করে দিতে পারো। আবার ইচ্ছে করলে এমনও হতে পারে, আমি একদিন পানি তুলব ও তুমি একদিন।’

সে বলল, ‘আচ্ছা, তোমার একদিন ও আমার একদিন, এভাবেই চলুক।’ যেদিন ওসমান (রা.)-এর দিন আসত, মুসলমানরা তাদের দু’দিনের প্রয়োজনীয় পানি তুলে রাখত। ইহুদি এটা দেখে বলল, ‘তুমি তো আমার কূপ নষ্ট করে ফেললে!’ এরপর ওসমান (রা.) বাকি অর্ধেকও কিনে নিলেন। (সিরাতে মোগলতাঈ)।

প্রাচুর্যে দান-সদকা বাড়ে : আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) অত্যন্ত গরিব সাহাবি ছিলেন। হিজরতের পর কোনো সম্পদ ছিল না তার। মদিনায় এসে ব্যবসা শুরু করলেন। আল্লাহতায়ালা অনেক বরকত দিলেন তাতে।

একপর্যায়ে তিনি ইসলামি ইতিহাসের অন্যতম বড় পুঁজিপতি বনে গেলেন। ইমাম জাহাবি (রহ.) তার বিপুল সম্পদ ও তা ব্যয়ের বিবরণ উল্লেখ করে বলেন, ‘আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) রাসুল (সা.)-এর যুগে তার অর্ধেক সম্পদ দান করে দিলেন। যার পরিমাণ ছিল চার হাজার দিনার। এরপর দান করলেন ৪০ হাজার দিনার। পাঁচশত ঘোড়া ও পাঁচশত উট যুদ্ধের বাহনরূপে প্রস্তুত করে দিলেন। তার অধিকাংশ সম্পদের উৎসই ছিল ব্যবসা।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১/১৮১)।

ধনাঢ্যের বিস্ময়কর তথ্য : ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেন, ‘বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) চার কোটি দিরহাম পরিমাণ সম্পদ রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। (যা বর্তমান হিসেবে প্রায় ১ হাজার ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।’ (তারিখুল ইসলাম লিজ জাহাবি : ৩/২১৪)। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাহাবি তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) প্রসঙ্গে ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেন, ‘তিনি যখন নিহত হন, তার কোষাধ্যক্ষের কাছে ১০ লাখ দিরহাম গচ্ছিত ছিল। তার স্থাবর সম্পত্তি হিসেব করে দেখা গেল, তার মূল্যমান দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি দিরহাম। তিনি তিনশত বাহন বোঝাই পরিমাণ সোনা রেখে মারা যান।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১/৩৯-৪০)।