ইসলাম একটি শাশ্বত, সার্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই সৃষ্টিজগতের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে ইসলামের নির্দিষ্ট নীতিমালা। আয়-উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি এ কিতাবে কোনো কিছুই অবর্ণিত রাখিনি।’ (সুরা মায়িদা : ৩৮)। ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের জন্য ইসলামের মৌলিক কিছু নীতিমালা রয়েছে। সেগুলো নিয়ে লিখেছেন -
ব্যবসায় কারও ক্ষতি করা নিষেধ : ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের উপকার করার মন-মানসিকতা থাকতে হবে। কারও ক্ষতি যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৩৪১)।
ধোঁকাণ্ডপ্রতারণা ও ফাঁকিবাজি নিষেধ : ব্যবসায় ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজির মতো অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সা.) একজন খাদ্য-বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি খাদ্যের ভেতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন, খাদ্যগুলো ভেজা বা নিম্নমানের। রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে পণ্যের মালিক! এটা কী?’ লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টি পড়েছিল।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি এগুলো খাবারের স্তূপের ওপর রাখলে না কেন; তাহলে লোকেরা দেখতে পেত! যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম : ১০২)।
মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে না : মিথ্যা অবশ্যই নিন্দনীয় অপরাধ। ব্যবসার সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ আরও বেশি মারাত্মক ক্ষতিকর। কোনো মুসলমান সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ৪২)। একজন মোমিনের দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক; কিন্তু কারও মাঝে মিথ্যা ও খেয়ানতের দোষ থাকা অস্বাভাবিক। রাসুল (সা.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, ‘একজন মোমিন দুর্বল হওয়া কি স্বাভাবিক?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ হতে পারে।’ আবারও জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মোমিন কি কৃপণ হতে পারে?’ বললেন, ‘হ্যাঁ হতে পারে।’ তারপর জিজ্ঞেস করা হলো, ‘একজন মোমিন মিথ্যুক হতে পারে?’ বললেন, ‘না, মোমিন কখনও মিথ্যুক হতে পারে না।’ (শুআবুল ঈমান : ৪৮১২)। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘চারটি গুণ যখন তোমার মধ্যে থাকবে, তখন দুনিয়াদারি সব ক্ষয়ে গেলেও তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তা হলো- আমানত সংরক্ষণ, কথায় সততা, উত্তম চরিত্র ও হালাল খাদ্য।’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৬৫২)।
ওজনে নিজ স্বার্থরক্ষায় কমবেশি করা যাবে না : অন্যকে ওজনে কম দেয়া আর নিজে বেশি নেয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধ্বংস- যারা পরিমাপে কম দেয়, তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদের মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ওজনে বা মাপে কম দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে।’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব : ৭৮৫)।
পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না : মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো, যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।’ (মুসলিম : ১০৬)। অন্য হাদিসে এেেসছে, রাসুল (সা.) বলেন, এক ব্যক্তি আসরের পর তার পণ্য সম্পর্কে কসম খেয়ে বলে, তাকে পণ্যটি এত এত মূল্যে দেওয়া হয়েছে। তার কথা ক্রেতা বিশ্বাস করল, অথচ সে মিথ্যুক। এ ধরনের ব্যবসায়ীর জন্য উল্লিখিত হাদিসে অত্যন্ত কঠিন ও বেদনাদায়ক শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৭৪, সুনানে নাসায়ি : ৪৪৬২)।
ব্যবসার সঙ্গে সুদকে মেশানো যাবে না : সুদ একটি মারাত্মক অপরাধ। সুদ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ব্যবসার নামে কোনো প্রকার সুদ চালু করা যাবে না। সুদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা কেয়ামতের দিন শয়তানের আসরে মোহাবিষ্টদের মতো দণ্ডায়মান হবে। কারণ, তারা বলে- ব্যবসা তো সুদের মতো; অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, হিসাবকারী এবং সাক্ষী- সবার প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন। আর তিনি বলেন, ‘তারা সবাই সমান।’ (মুসলিম : ১৫৯৮)।
অনুমানভিত্তিক ব্যবসা করা হতে বিরত থাকা : বৃক্ষস্থিত ফলকে বৃক্ষ হতে আহরিত ফলের বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মোজাবানা বলে। বিভিন্ন ধরনের মোজাবানা বর্তমানেও প্রচলিত আছে।
ক্ষেতে অকর্তিত খাদ্যশস্য যথা- গম, বুট ইত্যাদিকে শুকনো পরিষ্কার করা খাদ্য যথা- গম, বুট ইত্যাদির বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মোহাকালা বলে। সুদের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল (সা.) এগুলোকেও সুদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) মোজাবানা থেকে নিষেধ করেছেন।
অর্থাৎ বাগানে যদি খেজুর গাছ থাকে, তবে তার কাঁচা খেজুর পরিমাপকৃত খোরমার বিনিময়ে বেচাকেনা করা। আর যদি আঙ্গুর থাকে, তবে তা পরিমাপকৃত কিশমিশের বিনিময়ে কেনাবেচা করা। আর যদি তা ক্ষেতের ফসল হয়, তবে তা পরিমাপকৃত গমের বিনিময়ে কেনা- এসব থেকে তিনি নিষেধ করেছেন। (মুসলিম : ৩৭৫৫)।
অপরের মাল হরণ করার চেষ্টা করা যাবে না : ব্যবসার জটিল মারপ্যাঁচে অন্যের মাল হরণ করা হারাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)। হাদিসে এসেছে, একটি ব্যবসায়িক লেনদেনে উভয় পক্ষই খুঁতসহ পণ্যের সঠিক বর্ণনা দিতে হবে। বিজনেস কন্ডাক্ট সম্পর্কে জাবের (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তার প্রতি দয়া বর্ষণ করুক, যে বেচাকেনার সময় এবং অভিযোগের সময় সদয় থাকে।’ (বোখারি : ২০৭৬)।
নিজে ঠকা যাবে না এবং অপরকেও ঠকানো যাবে না : এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে অভিযোগ করল, সে বেচাকেনাতে প্রতারিত হয় বা ঠকে। রাসুল (সা.) বললেন, ‘যখন তুমি বেচাকেনা করবে, তখন বলে দেবে যে, কোনো প্রতারণা বা ঠকানোর দায়িত্ব আমি নেব না। তোমার জন্য তিনদিন পর্যন্ত পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার রয়েছে।’ (বোখারি : ৬৯৬৪)।