মৃত্যুর পর আবার জীবিত হতে হবে। বান্দার সব আমলের হিসাব হবে। এ বিশ্বাস ঈমানের অঙ্গ। যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে তারা মৃত্যু-পরবর্তী উত্থিত হওয়াকে মনে-প্রাণে সত্য বলে বিশ্বাস করে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে পুনরুত্থান অস্বীকার করা ঈমানবিরোধী বিষয়। মূলত আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসীরাই পুনরুত্থান ও মৃত্যুর পরের জীবনকে অস্বীকার করে। পৃথীবির সৃষ্টিলগ্ন থেকে নবীরা বান্দা পর্যন্ত আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। তারা মানুষকে আল্লাহর একক প্রভুত্ব ও গোটা জগৎ প্রতিপালনে আল্লাহর এককত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াতের সাথে সাথে পুনরুত্থানে বিশ্বাসের পাঠ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে এমন কিছু অলৌকিকতা ঘটিয়েছেন যা মানুষের মৃত্যুর পরের জগৎ; হাশর, পুনরুত্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেয়। অকাট্য প্রমাণ বহন করে। তেমনি একটি ঘটনা আসহাবে কাহাফ। যা মৃত্যু পরবর্তী উত্থিত হওয়ার একটি জীবন্ত প্রমাণ। আমাদের উচিত অতীত ইতিহাস থেকে থেকে শিক্ষা নিয়ে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়া। পবিত্র কোরআনের একাধিক সুরায় পুনরুত্থানের বিষয়টি বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে। পুনরুত্থানের সংবাদ দিয়ে সুরা তাগাবুনের সাত নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, কাফেররা দাবি করে যে, তারা কখনো পুনরুত্থিত হবে না। বলুন, অবশ্যই হবে, আমার পালনকর্তার শপথ, তোমরা নিশ্চয়ই পুনরুত্থিত হবে। তারপর তোমাদের অবহিত করা হবে যা তোমরা করতে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, আপনি বলুন, আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেন, অতপর মৃত্যু দেন পুনরায় কেয়ামতে তোমাদের একত্রিত করবেন, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না (সুরা জাসিয়া:২৬)। আল্লাহ মানুষকে অনর্থক, উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করেননি। বরং বিশেষ একমাত্র তার ইবাদতের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। দুনিয়ার জীবনে বান্দার কৃত সব বিষয়ের হিসাব নেয়া হবে পুনরুত্থানের পর। আল্লাহ বলেন, তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি, এবং তোমরা আমার কাছে প্রত্যাবর্তন করবে না (সুরা মুমিনুন : ১১৫)। নিঃসন্দেহ পুনরুথানের মাধ্যমে রবের কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং সে সকল কর্মের হিসাব দিতে হবে।
নবীজির অসংখ্য হাদিসে পুনরুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রসিদ্ধ হাদিসে জিবরীলের বর্ণনায় এসেছে, নবীজিকে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ঈমান হলো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। তাঁর ফেরেস্তা, কিতাব, রাসুল, মৃত্যু এবং পুনরুত্থান ইত্যাদিতে বিশ্বাস রাখা (আস-সুন্নাহ : ১২৪)। পুনরুত্থানে অবিশ্বাস করা আল্লাহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার নামান্তর। হাদিসে কুদসিতে এসেছে- আল্লাহ বলেন, আদম সন্তান আমাকে মন্দ বলে, অথচ আমাকে মন্দ বলা তার উচিত নয়। আদম সন্তান আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, অথচ আমাকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা তার উচিত নয়। আমাকে মন্দ বলার অর্থ হলো, আমার জন্য সন্তান সাব্যস্ত করা। আর মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার অর্থ হল, আমি তার পুনরুত্থান করব না এই কথা বলা (বুখারি:৩১৯৩)। নবীজি বলেছেন, আল্লাহ এক, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রাসুল, পুনরুত্থান ও তাকদির। এই চারটি বিষয়ের বিশ্বাসন ও স্বীকৃতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তি মোমেন হয় না (আস-সুন্নাহ: ১: ১২২)। অতএব, পুনরুত্থানে অবিশ্বাস মানেই ঈমানহীনতা। আর ঈমানহীনতা জাহান্নামের কারণ।
আসহাবে কাহাফের ঈমানি ঘটনা : কাহাফ শব্দের অর্থ বিস্তীর্ণ পার্বত্য গুহা। গুহাটির অবস্থাান বর্ণনায় কোরআন অস্পষ্ট। তাই তার সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা অসম্ভব। ইবনে আতিয়্যার এক বর্ণনা মতে এটি সিরিয়ায়। অন্য একটি বর্ণনা মতে স্পেনের গ্রানাডায়। ইবনে কাসির (রহ.) দ্বিতীয় মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইমাম কুরতুবীসহ অন্যান্য প্রায় সকল তাফসিরকারকের মতে এটি আফসুস তথা তরসুস শহরে যা এশিয়া মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত (মাআরেফুল কুরআন : ৭৯৯)।
ইবনে কাসির (রহ.) আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া কিতাবে লিখেছেন যে, আসহাবে কাহাফ ঈসা (আ.) এর পূর্ববর্তী যুগের লোক ছিল। যারা ধর্মীয়ভাবে মুশরিক ছিলেন। বাদশাহ দাকরানুমের সময়কার অভিজাত, শাসক পরিবারের সন্তান ছিলেন তারা। একদিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকালে তারা তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের মূর্তির সামনে সিজদারত অবস্থায় প্রতিমা সম্মান করতে দেখে। তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে হেদায়েতের রশ্মিতে আলোকিত করেন। তারা গভীর মনোযোগে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, এ সবই মিথ্যা। ইবাদত পাওয়ার একমাত্র যোগ্য আল্লাহ। যিনি লা-শারিক। তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাই, তারা পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে। এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনায়নের ঘোষণা দেন। যার বিবরণ কোরআনে আল্লাহ এভাবে দিয়েছেন- তারা ছিল কয়েকজন যুবক। যারা তাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান এনেছিল। আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম (সুরা কাহাফ : ১৩)।
ঈমান প্রকাশ করায় মুশরিকদের নির্যাতন : সত্য-মিথ্যার লড়াই চিরন্তন। মিথ্যা সর্বদাই সত্যকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু কখনোই সফল হতে পারেনি। সত্য উদ্ভাসিত হওয়ার সাথে সাথে মিথ্যা অপসারিত হয়। প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই (সুরা ইসরা : ৮১) আসহাবে কাহাফের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তারা ঈমানদার যুবকদের পুনরায় মুশরিক হওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিক বল প্রয়োগ করেন। কিন্তু মোমেনরা মুশরিকদের অত্যাচারে মাথা নত করেনি। এক আল্লাহর বিশ্বাস থেকে মুখ ফেরায়নি। দৃঢ় ঈমানের অধিকারী যুবকেরা দ্ব্যর্থকণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমাদের পালনকর্তা আসমান ও জমিনের পালনকর্তা, আমরা কখনো তার পরিবর্তে অন্য কোনো উপাস্যকে আহ্বান করব না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে (সুরা কাহাফ : ১৪)।
ঈমান রক্ষায় গুহায় আশ্রয় : শয়তানের অনুসারী মুশরিকরা অত্যাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। অকথ্য সব শাস্তিতে মোমেনদের জীবন-যাপনকে যাতনাময় করে তোলে। যুবকরা বুঝতে পারে ঈমান নিয়ে এই শহরে থাকা সম্ভব নয়। ঈমান বাঁচাতে হলে শহর ত্যাগ করতে হবে। মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করতে হবে। চলে যেতে হবে এমন স্থানে যেখানে ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। যেখানে নিশ্চিন্তে এক আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া যাবে। বাধা দেয়ার কেউ থাকবে না। তাই তারা আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে শহর ত্যাগের ইচ্ছা করেন। গুহা অভ্যন্তরে এসে রবের কাছে প্রার্থনা করেন। হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের নিজের কাছ থেকে রহমত দান করেন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকে সঠিকভাবে পূরণ করেন (সুরা কাহাফ : ১০)।
সৃষ্টির শুরু লগ্ন থেকেই অত্যাচারিদের দাপট চলে আসছে। আদমপুত্র হাবিল কাবিল থেকে যার সূচনা হয়েছিল। কেয়ামত পর্যন্ত জালেমের জুলুম নির্যাতন থাকবে। যুগে যুগে জালেম শাসকরা আল্লাহর নবীদেরও বিরোধিতা করেছে। তাদের অনেককে শারীরিক কষ্ট প্রদানের পাশাপাশি হত্যাও করা হয়েছে। মূলত জালেমরা তাদের জুলুমের মাধ্যমে সত্যের আওয়াজকে স্তমিত করতে চায়। নমরুদ, ফেরাঊন, আবরাহা, আবু জেহেল, উতবা, শায়বা এরা সত্যের পথরোধ করে ইতিহাসে ঘৃণিত হয়ে আছে। তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। নবীগণ ও সত্য পক্ষ সবসময়ই বিজয়ী হয়েছে। জুলুম ও জালেমের ধ্বংস অনিবার্য। এটা ইতিহাসের জ্বলন্ত প্রমাণ।
যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখেন তিনি তাদেরকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেন না। তাদেরকে সাহায্য করেন। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই ঈমানদাররা আল্লাহকে আহ্বান করেছেন, তখনই তিনি তাদের সাহায্যে সাড়া দিয়েছেন। আসহাবে কাহাফের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। তাদেরকে সাহায্যার্থে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে গুহায় তিনশ বছরের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেন। কোরআনে এসেছে, তখন আমি (আল্লাহ) কয়েক বছরের জন্য গুহায় তাদের কানের ওপর নিদ্রার পর্দা ফেলে দেই (সুরা কাহাফ : ১১)।
আসহাবে কাহাফের যুবকেরা ঈমান বাঁচাতে শহরের পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড়ি প্রশস্ত গুহায় আশ্রয় নেয়। আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে তারা সেখানে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়লে, আল্লাহতায়ালা তাদের নিদ্রার চাদরে ঢেকে দেন। বর্ণিত আছে যে, তারা দীর্ঘ তিনশত বছর ঘুমিয়ে থাকেন। এরপর আল্লাহ তাদের জাগ্রত করেন।
খাবারের প্রয়োজন হলে, তারা একজন সঙ্গীকে বাজারে পাঠান। তিনি বাজারে গেলে বুঝতে পারেন তার মুদ্রা অচল। অনুধাবন করতে পারেন তাদের প্রজন্মের পর কয়েক প্রজন্ম অতীত হয়েছে। বাজারের লোকেরা তা বুঝতে পেরে তাকে তৎকালীন বাদশাহর নিকটে নিয়ে যায় এবং তাদের এই অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে সকলে জানতে পারেন। এই দীর্ঘ সময় তাদের দেহকে অক্ষত রেখে আল্লাহ স্বীয় ক্ষমতার জানান দিয়েছেন। মৃত্যু-পরবর্তী পুনরুত্থান আল্লাহর জন্য কঠিন নয়, তার প্রমাণ রেখেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন পুনরুত্থান সত্য এবং কেয়ামত সংঘটনে কোনো সন্দেহ নেই। যিনি তিনশ’ বছর নিদ্রামগ্নতার পর কোন ধরনের বিবর্তন ছাড়া উত্থিত করতে পারেন। তিনি মানুষের মৃত্যুর পর অস্থি, মজ্জা মাটিসার হওয়ার পরেও পুনরুত্থান করতে সক্ষম। বস্তুত, আল্লাহ যখন কোনো কিছু করার ইচ্ছা করেন, তিনি সেটাকে বলেন হও, ফলে তা হয়ে যায় (সুরা ইয়াসিন : ৮২)।