ইসলামি শরিয়তের কিছু বিধান অপরিবর্তনীয়। এখানে যুক্তিতর্ক কিংবা ইজতিহাদ (ধর্মীয় বিধানে গবেষণামূলক প্রয়াস)-এর মোটেও সুযোগ থাকে না। মিরাস তথা উত্তরাধিকার এমনই একটি বিধান। যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ বিধান। ইসলামের ফরজ বিধানগুলোতে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে চমৎকার একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। তা হলো, আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর নামাজ ফরজ করেছেন, কিন্তু এর রাকাত সংখ্যা, আদায় করার পদ্ধতি, ভঙ্গের কারণ প্রভৃতি বিধান বিস্তারিত বলেননি। এটাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাতের ওপর নির্ভরশীল রেখেছেন। তদ্রূপ আমাদের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন, কিন্তু জাকাত প্রদানের পদ্ধতি কী হবে, তাও হাদিস থেকে জানতে হয়। আর মিরাসের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বিস্তারিত বলে দিয়েছেন।
উত্তরাধিকার সংক্রান্ত তিনটি আয়াত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি আয়াতেই ‘আলিম’ (জ্ঞানী) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এটি আল¬াহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা : ১১)। দ্বিতীয় আয়াতে উদ্ধৃত হয়েছে, ‘এটি আল¬াহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত আদেশ, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও সহিষ্ণু।’ (সুরা নিসা : ১২)। তৃতীয় আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন, যেন তোমরা বিভ্রান্ত না হও। আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নিসা : ১৭৬)। এর মাধ্যমে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহতায়ালা ওয়ারিশদের জন্য যে অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেগুলোতে অনেক রহস্য রয়েছে। যদি মানুষের ওপর উত্তরাধিকার বণ্টনের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হতো, তাহলে তারা উপকারী হওয়াটাকে বণ্টনের মূলভিত্তি নির্ধারণ করতো। প্রকৃতপক্ষে কে উপকারী হবে এবং সর্বাধিক উপকার কার কতটুকু অংশ দ্বারা অর্জিত হবে, এর নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এজন্য আল্লাহতায়ালা নিজেই সবকিছু বর্ণনা করে দিয়েছেন। (মাআরিফুল কুরআন)।
মিরাস এমন বিষয় যার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সরাসরি অসিয়ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানসন্ততি সম্পর্কে অসিয়ত করছেন যে, পুরুষের অংশ হবে দুই নারীর সমান।’ (সুরা নিসা : ১১)। এটি একটি শর্তসাপেক্ষ আইন। নারী কখন পুরুষের কত অংশের কত ভাগ পাবে এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বিশদ আলোচনা রয়েছে। সে বিষয়গুলো বিস্তারিত না জেনে মিরাসের বিষয়ে নারীর সমান অধিকার সম্পর্কে আপত্তি করা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সমাজে বিপত্তি ঘটে মূলত নারীর মিরাসের অধিকার কতটুকু তা নিয়ে নয়, বরং ইসলাম নারীকে যতটুকু অধিকার দিয়েছে ততটুকুও নারীকে না দেয়ার কারণে। একজন নারী তার বাবা থেকে মিরাস পায়, স্বামী ও সন্তান থেকে পায়। সমাজের মানুষ কি নারীর সে অধিকারগুলো আদায় করে? সোজাসাপটা উত্তর - করে না। তাই নারী মিরাসে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর কিছু অজ্ঞ ও জালেম আত্মীয় অন্যের উত্তরাধিকার; সম্পত্তি অন্যায়ভাবে ভোগ করতে থাকে। এর মৌলিক কারণ হলো ঈমানের দুর্বলতা, লোভ লালসা ও ইসলাম অসমর্থিত সামাজিক প্রথা।
মিরাস যথাযথ বণ্টন না করার শাস্তি : অন্যায়ভাবে অন্যের উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভোগকারী ব্যক্তি নানারকম শাস্তির সম্মুখীন হবে। এর কয়েকটি নিম্নরূপ :
এক. এমন ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘনকারী। সীমালঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে জাহান্নাম হবে আবাসস্থল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহ ও রাসুলের অবাধ্য হয় এবং তার সীমা লঙ্ঘন করে, তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে অনন্তকাল থাকবে। তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।’ (সুরা নিসা : ১৪)।
দুই. মিরাস আত্মসাৎকারী প্রকারান্তরে সম্পর্ক ছিন্নকারী। এর শাস্তিও ভয়াবহ। এমন ব্যক্তির ওপর আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরই অভিশাপ করেন। আর করেন বধির ও অন্ধ।’ (সুরা মুহাম্মদ : ২২-২৩)। হজরত আবু বাকরা ছাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল¬াহ (সা.) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও অন্যের ওপর অন্যায়-অবিচার করা এমন পাপ, যার শাস্তি আল্লাহতায়ালা ইহকালেও দ্রুত প্রদান করেন, আবার আখেরাতের জন্যও শাস্তি জমিয়ে রাখেন।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৭৪৯৬)। অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বোখারি : ৫৯৮৪)। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয় মূলত কীভাবে? বাবার মৃত্যুর পর ভাই-বোন সবাই যার যার প্রাপ্য অধিকার অনুযায়ী বাবার সম্পদে অংশীদার। বোনেরা ভাইদের অপেক্ষায় থাকে, কখন ভাইয়েরা বোনদের হক বুঝিয়ে দিবে, আবার হক দাবি করলে বোনেরা বাপের বাড়ি আসতে সঙ্কোচ করবেন- সামাজিক প্রথা ও ভাইদের দীনদারিতার অভাবই মূলত বোনদের অধিকার বঞ্চিত করে। আর বোনরা সোচ্চার হলে আত্মীয়তার বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। যা মূলত বোনদের ওপর এক অমানবিক জুলুম। যার হিসাব ভাইয়েরা আখেরাতে দিতে বাধ্য।
তিন. মিরাসের হক বঞ্চিতকারী ব্যক্তি কেয়ামত দিবসে হতদরিদ্র অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কি জানো অভাবী কে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমাদের মাঝে যার দিরহাম (টাকা-কড়ি) ও ধনসম্পদ নেই। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত অভাবী সে, যে কেয়ামত দিবসে অধিক নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ এমন অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি বা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করেছে, কাউকে হত্যা বা প্রহার করেছে। তখন তার নেকি এমন ব্যক্তিদের দেয়া হবে, যাদের সঙ্গে সে অন্যায়গুলো করেছে। নেকি শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম : ২৫৮১)।
চার. মিরাসি সম্পদ তার প্রকৃত হকদারকে না দিয়ে আত্মসাৎ করা কবিরা গুনাহ। গাতফান গোত্রের এক লোক নিজ এতিম ভাতিজির উত্তরাধিকার সম্পত্তি দিতে অস্বীকার করলে আল্লাহতায়ালা আয়াত নাজিল করে বলেন, ‘এতিমদেরকে তাদের সম্পদ দিয়ে দাও, আর ভালো সম্পদকে মন্দের দ্বারা পরিবর্তন করো না এবং তাদের (এতিমদের) সম্পদ নিজের সম্পদের সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ো না। নিশ্চয় এটা মহাপাপ।’ (সুরা নিসা : ০২)।
পাঁচ. যারা অন্যের উত্তরাধিকার সম্পদ ভোগ করে, তারা মূলত আগুন দিয়ে নিজেদের উদর পূর্ণ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা এতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে, তারা নিজেদের পেট কেবল আগুন দ্বারাই পূর্ণ করেছে। তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা : ১০)।
মিরাস বণ্টনের পুরস্কার :
এক. উত্তরাধিকার সম্পত্তি দিয়ে দেয়া মানে আল্লাহর আনুগত্য করা, তার বিধান মেনে নেয়া। এর পুরস্কার নিঃসন্দেহে জান্নাত। মিরাসের বিধান বর্ণনা শেষে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে কেউ আল্লাহ ও রাসুলের আদেশমতো চলবে, তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এ তো এক মহাসাফল্য।’ (সুরা নিসা : ১৩)।
দুই. মানুষের সম্পদ ভোগ না করে, আটকে না রেখে মূল মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া তাকওয়ার অনিবার্য দাবি। তাকওয়া মানে আল্লাহকে ভয় করা। এর পুরস্কার উভয় জগতের সফলতা।
আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে তাকওয়া অবলম্বনকারীর জন্য রিজিকের অফুরন্ত দুয়ার খুলে দেবেন, আর আখেরাতে দেবেন মহাপুরস্কার। তিনি বলেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করবে, তিনি তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দেবেন, এবং তাকে ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।’ (সুরা তালাক : ২-৩)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করবে, তিনি তার পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।’ (সুরা তালাক : ৫)। সুতরাং পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিত, সবার উত্তরাধিকার সম্পত্তি পরিপূর্ণরূপে বুঝিয়ে দেয়া। কারো প্রাপ্য অধিকার যেন বিনষ্ট না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। আল্লাহতায়ালা আমাদের পাপমুক্ত পুণ্যময় জীবন দান করুন। আমিন।