হালাল রিজিক ও ইসলাম
ইসমাঈল হুসাইন
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে, সবাই রিজিকের মুখাপেক্ষী। রিজিক ছাড়া কোনো প্রাণীই বাঁচতে পারে না। মানুষ, জিন, পশুপাখি, জীবজন্তু, কিটপতঙ্গ সবকিছুই রিজিকের মুখাপেক্ষী। আর রিজিক বলা হয় এমন বস্তুকে, যা কোনো প্রাণী আহার্য্যরূপে গ্রহণ করে, যা তার দৈহিক শক্তি সঞ্চার করে, প্রবৃদ্ধি সাধন করে ও রক্ষা করে। এ প্রাণীকুলের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ন্যস্ত। এ দায়িত্ব আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি। আল্লাহকে কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার মতো কোনো সত্তা বা শক্তি মহাবিশ্বে নেই; বরং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে প্রাণীকুলকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের রিজিকের দায়িত্বও স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছেন।
রিজিকের প্রকার : রিজিক দুই প্রকার- হালাল ও হারাম। কোনো ব্যক্তি যখন শরিয়তসম্মত পন্থায় উপার্জন করে তা উপভোগ করে, তখন তাকে হালাল রিজিক বলে। বিপরীতে যখন কোনো ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে তা উপভোগ করে, তখন তা তার জন্য হারাম রিজিক হিসেবে সাব্যস্ত হবে। কোনো ব্যক্তি যদি অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করে অপেক্ষা করতে থাকে, তাহলে যে কোনোভাবেই হোক বৈধ পন্থায়ই তার কাছে রিজিক পৌঁছাবে। হায়াত থাকতে কেউ কোনো দিন মারা যায়নি, আর অনাহারে মারা যাবেও না। আল্লাহতায়ালা যতটুকু সময়ের জন্য যাকে সৃষ্টি করেছেন, তার হায়াত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাকে অবশ্যই রিজিক দেবেন। এটা তাঁর ওয়াদা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই। তিনি তাদের স্থায়ী, অস্থায়ী পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত; সুস্পষ্ট কিতাবে সবকিছুই লিপিবদ্ধ রয়েছে।’ (সুরা হুদ : ৬)।
হালাল রুজি অন্বেষণ : হালাল রিজিকের অন্বেষণ করা ফরজতুল্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে; যেন সফল হও।’ (সুরা জুমা : ১০)। এ আয়াতে মহান আল্লাহ নামাজ সম্পন্ন করার পর হালাল রিজিক তালাশের নির্দেশ দিয়েছেন। হালাল রিজিক সন্ধানের একটি উপায় হলো, ব্যবসা করা। মহান আল্লাহ সঠিক পন্থায় ব্যবসাকে হালাল ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল রিজিক তালাশ করা অন্য ফরজের পর ফরজ।’ (আল মুজামুল কাবির : ৯৯৯৩)।
হালাল রুজি ভক্ষণ : রিজিক হাসিলের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা হালাল পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি সবাইকে হালাল রুজি উপার্জনের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ কর, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ১৬৮)। মহান রব মোমিনদের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পবিত্র খাদ্যদ্রব্য থেকে আহার কর, যা কিছু আমি তোমাদের রিজিক হিসেবে প্রদান করেছি। আর আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)।
নবীদের হালাল রুজি গ্রহণের নির্দেশ : পবিত্র কোরআনে নবীদের প্রতি হালাল রিজিক সন্ধানের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘হে রাসুলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করুন আর সৎকাজ করুন। আপনারা যা কিছু করেন, সে সম্পর্কে আমি অবহিত।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)।
যারা হালাল উপার্জন করতেন : আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নবী ছাগল চরাতেন।’ সাহাবিরা বললেন, ‘আপনিও কি এমনটি করতেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি মক্কাবাসীর ছাগল কয়েক কিরাত (আরবের পরিমাপ বিশেষ) দ্বারা চরিয়েছি।’ (আল জামিউস সহিহ : ২২৬২)। মিকদাদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি নিজের হাতের উপার্জনের চেয়ে উত্তম খাবার খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) তার নিজের হাতের উপার্জন থেকে খেতেন।’ (বোখারি : ২০৭২)।
ভূমির মালিককে চাষ করার নির্দেশ : মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার জমি আছে, সে নিজেই চাষ করবে।’ (বোখারি : ২৩৪০)। অন্য হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, ‘যে কোনো মুসলমান কোনো গাছ রোপণ করবে বা ক্ষেত-খামার করবে, তার থেকে কোনো পাখি খাবে বা মানুষ বা প্রাণী খাবে, তা দ্বারা সে সদকার পুণ্য পাবে।’ (বোখারি : ২৩২০)।
হালাল উপার্জন জান্নাতের কারণ : রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল রিজিক ভক্ষণ করল, আর সুন্নতমতে আমল করল এবং মানুষ তার কষ্ট থেকে নিরাপদ রইল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এ ধরনের লোক বর্তমানে অনেক।’ তিনি বললেন, ‘আমার পরে তা কয়েক যুগ পাওয়া যাবে।’ (তিরমিজি : ২৫২০)।
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.)-এর দরবারে নোমান বিন কাউকাল (রা.) এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি বলেন, যদি আমি ফরজ নামাজ আদায় করি, হারামকে হারাম মনে করি ও হালালকে হালাল মনে করি, তাহলে কি জান্নাতে যাব?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ যাবে।’ (মুসলিম : ১৫)।
হারাম রিজিক বর্জনের নির্দেশ : রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর সুন্দরভাবে ইবাদত কর। কেননা, কোনো আত্মা তার রিজিক পরিপূর্ণ হওয়া ছাড়া ইন্তেকাল করবে না, যদিও তাতে দেরি হয়। তাই তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর সুন্দরভাবে তালাশ কর। তোমরা হালালকে গ্রহণ কর ও হারামকে বর্জন কর।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৪৪)।