ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নারীর উপার্জনে ইসলামের নির্দেশনা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
নারীর উপার্জনে ইসলামের নির্দেশনা

আল্লাহতায়ালা নারী-পুরুষকে যেভাবে স্বভাবগত এবং গঠনগত স্বাতন্ত্র্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তেমনিভাবে জাগতিক ও ধর্মীয় জীবনে তাদের কর্মপন্থা ও দায়বদ্ধতায়ও বৈচিত্র্য রেখেছেন। নারীর গঠনগত ও মনস্তাত্তিক কিছু ব্যবধান বিবেচনায় ইসলামি আইনে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য প্রণালিতেও বিধানগত কিছু ভিন্নতা রয়েছে। আল্লাহতায়ালা নারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা ঘরের অভ্যন্তরে অবস্থান করো।’ (সুরা আহজাব : ৩৩)। আয়াতটিতে পর্দার বিধানের সঙ্গে নারীর দায়িত্বের সীমারেখা সম্বন্ধেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তা হলো, সে তার স্বামীর সংসারের প্রধান রক্ষণাবেক্ষণকারী।

নারী তার স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীল : পুরুষরা ক্ষেত-খামার, অফিস-আদালত, চাকরি-বাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কায়িক শ্রম ব্যয় করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংসার পরিচালনার কাঁচামাল সংগ্রহ করবে। আর নারী সে কাঁচামালের সুন্দর ব্যবহারে সংসারকে সুখময় করে তুলবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা।

নারী যখন বাবার ঘরে থাকবে, তখনও তার সংসার পরিচালনার আর্থিক দায়িত্ব তার ওপর আরোপিত নয়। ঘরোয়া পরিবেশে থেকেই সে তার শিক্ষা-দীক্ষাসহ যাবতীয় যোগ্যতা অর্জনে মনোযোগী হবে। স্বামীর ঘরে গিয়েও সে তার সংসারের নতুন রাজ্যকে সবটুকু গুণ-বৈশিষ্ট্য দিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ করে তুলবে। এটিই তার প্রধানতম দায়িত্ব। এর বাইরে তার ওপর অতিরিক্ত কোনো দায়িত্বারোপ করা হয়নি ইসলামে। এমনকি কোনো স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে ঘরের বাইরের কাজে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করার সুযোগ নেই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নারী তার স্বামীর ঘরের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। আর কেয়ামতের দিন সে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বোখারি : ৮৯৩)।

নারীর প্রধানতম কাজ কী : নারীর প্রধানতম কর্তব্য হলো, স্বামীর ঘর-সংসার পরিচালনা করা, তার পরিবারের সার্বিক দিক লক্ষ্য রাখা, তার সন্তানদের প্রতিপালন, পরিচর্যা করে শিক্ষা-দীক্ষাসহ সার্বিকভাবে উপযোগী করে তোলা এবং স্বামীর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ৭/৮২)। অন্যদিকে নারীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় ব্যয়, সংসার পরিচালনা ও সন্তানাদিসহ পারিবারিক ও সামাজিক অন্যান্য ব্যয়ভার থেকে নারীকে সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে তার ওপর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যাবতীয় দায়ভার স্বামী বা পিতার ওপর আরোপিত হয়েছে। (প্রাগুক্ত)।

নারীর দায়মুক্তির কারণ : শক্তি, ক্ষমতা ও বুদ্ধির বিবেচনাসহ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট দিয়ে পুরুষকে নারীর সেবক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নেতৃত্বের প্রধান উৎস-উপাদান হলো, সেবাব্রত। সেবার যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে পুরুষকে নারীর অভিভাবক বানানো হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পুরুষ নারীর ব্যবস্থাপক। কারণ, আল্লাহ তাদের একজনকে অপরের ওপর মাহাত্ম্য দান করেছেন এবং তারা তাদের ধন-সম্পদ (নারীদের ওপর) ব্যয় করে। সুতরাং সতী-সাধ্বী নারীরা হয় অনুগতা এবং আল্লাহতায়ালা যেসব বিষয় হেফজতযোগ্য করেছেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা তার হেফাজত করে।’ (সুরা নিসা : ৩৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালাকে ভয় করো। কারণ, তোমরা তাদের আল্লাহর নিরাপত্তা সূত্রে গ্রহণ করেছ এবং তোমরা তাদের সতীত্বকে আল্লাহর বিধানের বিনিময়ে বৈধ করে নিয়েছ। তোমাদের ওপর তাদের সঙ্গত ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।’ (মুসলিম : ১২১৮)।

নারীর কর্মযজ্ঞ ও ইসলাম : ইসলামের দৃষ্টিতে নারী যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষা লাভে অগ্রসর হতে পারে, তেমনি কৃষি ও ব্যবসার কাজে পরোক্ষ অংশগ্রহণ করারও সম্পূর্ণ অধিকার রাখে। জীবিকার জন্য বিভিন্ন কাজ-কারবার, শিল্প-কারখানা স্থাপন, পরিচালনা বা তাতে কাজ করারও অধিকার রয়েছে নারীদের। সেই সঙ্গে সমাজ ও জাতির কল্যাণমূলক বহুবিধ সামষ্টিক কাজ আঞ্জাম দেওয়াও তাদের জন্য নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, নারীদের এসব কাজে নেমে যেতে হবে এবং এসব করা তাদের জন্য একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। নারীরা এসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুক, ইসলামে তা কাম্য নয়। তবে পরিবার বা সমাজে এমন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যার কারণে নারীদেরও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন পড়ে। তখন যথাসাধ্য শরঈ বিধান পালন সাপেক্ষে নারীদের জন্যও কর্মসংস্থানের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে।

এমনকি নারীরা যদি দায়িত্ব ও কর্তব্যের বাইরে গিয়ে কর্মসংস্থান করতে আগ্রহ বোধ করে, তবে পিতা বা স্বামীর অনুমোদন এবং শরঈ বিধান পালন সাপেক্ষে তারও অনুমতি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কাউকে নিরুৎসাহিত করাও রীতি নয়। তবে তাদের আলাদা কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই ইসলামের দাবি।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী নিজ ঘরে বসে শিল্পকর্ম করতেন এবং তা বিক্রি করে ঘর-সংসারের খরচাদি চালাতেন। একদিন তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আমি একজন কারিগর মেয়ে। আমি আমার তৈরি করা দ্রব্যাদি বিক্রি করি। এ ছাড়া আমার ও আমার স্বামীর এবং আমার সন্তানদের জীবিকার অন্য কোনো উপায় নেই।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘এভাবে উপার্জন করে তুমি তোমার সংসারের প্রয়োজন পূরণ করছ। এতে তুমি বিরাট সওয়াবের অধিকারী হবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৬১৩০, ১৬০৮৬)।

কল্যাণমূলক কাজে নারীর সুযোগ : ইসলামি শরিয়ত নারী সমাজকে মানবতার সেবা ও কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। উপার্জনের জন্য কাজ করা এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে সেজন্য ঘরের বাইরে যাওয়া নারীদের জন্য নিষিদ্ধ নয়। তবে তাতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও বন্ধুত্ব-সখ্যতা করে ইসলামি বিধান লঙ্ঘন করা সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ। ইসলাম নারীদেরকে কর্মসংস্থান গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তার জন্য ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিনিধি নিয়োগসহ যাবতীয় লেনদেনে অংশগ্রহণ করার অনুমতি আছে। যতক্ষণ সে এ জাতীয় কারবারে অংশগ্রহণ করে শরঈ বিধান ও আচরণবিধির ব্যাপারে যত্নবান থাকবে, ততক্ষণ তাকে এ থেকে নিবৃত্ত করার অধিকার কারও নেই। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ৭/৮২)। মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, ‘যদি কোনো নারীর জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সামান বা অন্য কোনো পন্থা না থাকে, তবে সাজসজ্জা ছাড়া পর্দার সঙ্গে চাকরি ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশে বের হওয়া তার প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ার অন্তর্ভুক্ত। তবে শর্ত হলো, সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য বের না হওয়া; বরং বোরকা বা বড় চাদর গায়ে দিয়ে বের হবে।’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন : ৭/১৩)।

যেসব শর্তে নারীরা ঘরের বাইরে কাজে যেতে পারে : নারীরা তিনটি শর্তে নিজ ঘরের বাইরে চাকরি বা কাজ করতে যেতে পারবে। তা হলো- ১. কাজটি গোনাহের না হওয়া, ২. নারীর কাজটি এমন স্থানে না হওয়া, যেখানে পরপুরুষের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হয়, ৩. কাজের জন্য এমন সাজসজ্জাসহ বের না হওয়া, যা ফেতনা-ফ্যাসাদের দিকে প্ররোচিত করে। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ৭/৮৩-৮৪)। মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবি (রহ.) বলেন, ‘নারীর ভরণ-পোষণ স্বামীর দায়িত্বে। কিন্তু কোনো নারীর যদি উপার্জনে সক্ষম অভিভাবক না থাকে, তাহলে নিরুপায় অবস্থায় অর্থ উপার্জনের জন্য তার কর্ম বা চাকরি করার অনুমতি আছে। তবে এ জন্য শর্ত হলো, তার ভাব-গাম্ভীর্যতা এবং অনুকূল পরিবেশ ও পর্দার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরপুরুষের সঙ্গে একত্রে দায়িত্ব পালন করা জায়েজ নেই।’ (আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল : ৬/৩৮)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত