হারাম থেকে বেঁচে থাকা মহান আল্লাহর বিধান। এর থেকে বেঁচে থাকতেই হবে। হালালের মাধ্যমেই আমাদের অর্থনীতির সার্বিক সমাধান খুঁজতে হবে। হালাল কখনোই অসম্ভব নয়। তবে হালালের জ্ঞান ও অনুসন্ধানে ত্রুটি থাকার কারণে কখনও মনে হতে পারে, সব কিছুই হারাম, এ যুগে হালাল অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ ধারণা একেবারেই ভুল। আর হারাম উপার্জন এমন একটি ধ্বংসাত্মক বিষয়, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ইবাদতেরও প্রত্যাশিত মূল্য পাওয়া যায় না। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘হারাম খাদ্য গ্রহণ করে ইবাদত করা মূলত গোবরের ওপর ইমারত নির্মাণের মতোই।’ (কিতাবুল আরবাঈন ফি উসুলিদ্দীন ফিল আকায়েদ ওয়াল আসরার : ৭৫)। সেজন্য ইমাম আবু ইউসুফ আল গাসুলি (রহ.) বলেন, ‘আমি ষাট বছর আমার উপার্জনের হালাল-হারাম নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করেছি।’ (আল হাসসু আলাত তিজারা : ৪৩)।
হালাল-হারামে সতর্কতার অভিনব গল্প : একবার বিখ্যাত বুজুর্গ বিশর হাফি (রহ.)-এর বোন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর কাছে প্রশ্ন করলেন, ‘রাতে আমরা আমাদের বাড়ির ছাদে বসে চরকায় সুতা কাটি। তখন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে সরকারি প্রহরীদের বিশাল কাফেলা হাতে মশাল নিয়ে অতিক্রম করে। তাদের সেই মশালের আলো আমাদের পর্যন্ত চলে আসে। এ অবস্থায় সেই মশালের আলোয় আমাদের জন্য চরকায় সুতা কাটা কি বৈধ হবে?’ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’ প্রশ্নকারী জবাবে বললেন, ‘আমি বিশর হাফির বোন।’ এ কথা শুনে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) কান্না করলেন। এরপর বললেন, ‘তোমাদের মতো উচ্চ পর্যায়ের লোকদের ঘর থেকে এমন প্রকৃত ও সত্য তাকওয়াই প্রত্যাশিত। সুতরাং তুমি তাদের আলোতে সুতা কাটবে না।’ (রিসালাতুল মুসতারশিদিন : ৭৫)।
হারামের ভয়ে হালাল বর্জন করা সর্বোচ্চ তাকওয়া : বর্তমানে স্পষ্ট হারাম জানার পরও আমরা তা থেকে বিরত থাকতে পারি না। চাকরি-ব্যবসায় হারাম আছে কি-না, তা খোঁজ করে দেখি না। এ ব্যাপারে উদাসীন থেকে ইবাদত করি। অথচ ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ তাকওয়া হলো, হারামের ভয়ে হালালও ছেড়ে দেয়া।’ (ইরশাদুস সারি লি শারহি সহিহিল বোখারি : ১/১৯১)। সুতরাং যে কোনো লেনদেনে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে সেটি হালাল কি-না, তা বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া জরুরি। হালাল গ্রহণের নগদ ফায়দা হলো, অন্তর নরম হয়ে যাওয়া। এতে আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা সহজ হয়। মানুষের সঙ্গে সদাচরণ বৃদ্ধি পায়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘অন্তরগুলো নরম হয় কীসে?’ তিনি বললেন, ‘হালাল গ্রহণের মাধ্যমে।’ (তাবাকাতু হানাবিলা : ১/২১৯)।
আর্থিক সংকটে সবর করা হারাম উপার্জনের চেয়ে শ্রেয় : সালাফের নারীদের রীতি ছিল, তাদের স্বামীরা যখন উপার্জনের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হতেন, তখন তারা তাদের এ বলে বিদায় দিতেন, ‘আমাদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আমাদের হারাম কিছু খাওয়াবে না। জেনে রেখো, আমরা আর্থিক সংকটের কারণে ক্ষুধা ও কষ্টের ওপর সবর করতে প্রস্তুত। তবে (হারাম খেয়ে) আখেরাতের আগুনে আমরা সবর করতে পারব না।’ বিশিষ্ট তাবেঈ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ.)-এর রীতি ছিল, তিনি যখন কাউকে বিদায় জানাতেন, তখন বলতেন, ‘আল্লাহকে ভয় করবে। তোমার জন্য যে পরিমাণ হালাল রিজিক বরাদ্দ রয়েছে, শুধু সেই হালাল রিজিকই সন্ধান করবে। তুমি যদি হারাম রিজিক গ্রহণ করো, তাহলে এতেও তোমার জন্য যে পরিমাণ রিজিক বরাদ্দ রয়েছে, এর চেয়ে অধিক গ্রহণ করতে পারবে না।’ (তাবাকাতে কোবরা : ৭/২০১)।
উপার্জনে দ্বীনকে দুনিয়ার ওপর প্রাধান্য দিতে হবে : বাগদাদের বিখ্যাত বুজুর্গ আবু আবদুল্লাহ হারেস ইবনে আসাদ আল মুহাসিবি (রহ.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে; তার পিতা বিত্তবান ছিলেন। ইন্তেকালের সময় সত্তর হাজার দিরহাম রেখে গেলেন। একবার হারেস (রহ.)-এর এক দিরহামের এক ষষ্ঠাংশ প্রয়োজন দেখা দিলো। কিন্তু তিনি তার পিতার এ বিশাল সম্পদ থেকে সামান্য পরিমাণ সম্পদও গ্রহণ করেননি। কারণ, তার পিতার আকিদা-বিশ্বাসে মারাত্মক পর্যায়ের ত্রুটি ছিল। তাই তাকওয়ার দিকে লক্ষ্য করে তিনি তার পিতার সম্পদ গ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। (তাহজিবুত তাহজিব : ২/১৩৫)।
জীবনের শেষ মুহূর্তেও হারামের ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা : ফকিহ ইবনু হামেদ আল ওয়াররাক (রহ.) পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের নানা গ্রন্থ হাতে অনুলিপি করে দিতেন। সেই লব্ধ অর্থ দিয়ে হজ করতেন। এক হজের সফরে পথিমধ্যে তার প্রচুর পানির তৃষ্ণা পায়। পিপাসার তীব্রতায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। তখন এক হাজি সামান্য পানি নিয়ে এলো। এমন কঠিন সময়ে তিনি সেই হাজিকে বললেন, ‘এ পানি কোত্থেকে এনেছেন?’ আগত হাজি বললেন, ‘আপনার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এ পরিস্থিতিতেও এ রকম প্রশ্ন করছেন!’ জবাবে ইবনে ওয়াররাক (রহ.) বললেন, ‘হ্যাঁ, ভাই! এটিও প্রশ্ন করার সময়। এ সময় তো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। এ সময়েও আমার জানা দরকার, পানির উৎস কী?’ ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, ‘এরপর ওই সফরেই তার ইন্তেকাল হয়ে যায়।’ (তাবাকাতে হানাবিলা : ২/১৭৭)।
অতি সাধারণ বিষয়েও হারামের ব্যাপারে সচেতনতা : হাফেজ জাকি উদ্দিন আবদুল আজিম মুনজিরি (রহ.)-এর সময়ে ইলম ও আমল সর্বদিক থেকে শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। একবার কোনো এক সফরে ঘটনাক্রমে গোসলখানায় তার গায়ে গরম পানি পড়ে। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চলতে অক্ষম হয়ে যান।
শরীর দুর্বল হয়ে আসে। তাকে একটি দোকানের পাশে রাস্তায় শুইয়ে দেওয়া হলো। এ পরিস্থিতিতে তার সফরসঙ্গী হাফেজ দিমইয়াতি (রহ.) তাকে প্রস্তাব করলেন, ‘আমরা আপনাকে ওই দোকানের সামনের টুলে বসিয়ে দিই? এখন তো দোকান বন্ধ। দোকানের সামনে এভাবে কেউ বসলে কারও ক্ষতি হবে না।’ তিনি এ কঠিন পরিস্থিতিতেও বললেন, ‘দোকানের মালিকের অনুমতি ছাড়া তা কীভাবে সম্ভব?’ এরপর তিনি আর ওই দোকানে বসেননি। বরং রাস্তায়ই শুয়ে রইলেন। (প্রাগুক্ত : ১৮৬-১৮৭)।
হারাম ত্যাগ করলে হালাল পথ বের হয় : অনেক সময় আমরা হারাম পথে উপার্জন করি। ভাবি, আমার সামনে তো হালাল পথ নেই। অথচ বাস্তবতা হলো, কেউ যদি আল্লাহর ভয়ে হারাম পরিত্যাগ করে, তাহলে আল্লাহতায়ালা তাকে হালাল পথ বের করে দেন। ইবনে আতাউল্লাহ এস্কেন্দারি (রহ.) বলেছেন, ‘বান্দা নগদ হারাম পরিত্যাগ করবে, আর আল্লাহ তাকে বাকিতে প্রতিদান দেবেন, এমন হবে না।’ (প্রাগুক্ত : ৯১)। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) লিখেছেন, ‘শরিয়তের বিধান পালন করতে গিয়ে যে হারাম থেকে বেঁচে থাকবে, আল্লাহতায়ালা তাকে এর পরিবর্তে হালালের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (প্রাগুক্ত : ৮৭-৯১)।
লেখক : সিএসএএ, এ্যাওফি, বাহরাইন ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি লিমিটেড