ঘুষ আদান-প্রদান করা শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কোরো না এবং জনগণের সম্পদের কিয়দাংশ জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশে শাসন কর্তৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)। ঘুষের আদান-প্রদান হারাম হওয়ার বিষয়টি হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। সুলাইমান ইবনে ইয়াসার (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.)-কে খায়বারে পাঠাতেন। তিনি সেখানকার বাগানের ফলের পরিমাণ নির্দিষ্ট করতেন। একবার ইহুদিরা তাদের স্ত্রীদের অলংকার একত্রিত করে ইবনে রাওয়াহা (রা.)-কে দিতে চাইল। বলল, ‘আপনি এ অলংকার গ্রহণ করুন এবং পরিমাণে কিছু হ্রাস করুন।’ ইবনে রাওয়াহা (রা.) বললেন, ‘হে ইহুদি সম্প্রদায়! আমি আল্লাহর সব সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে তোমাদের নিকৃষ্ট মনে করি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তোমাদের ওপর জুলুম করতে চাই না। তোমরা আমাকে যে উৎকোচ দিচ্ছ, তা হারাম। এটা আমরা খাই না।’ ইহুদিরা বলতে লাগল, ‘এ জন্যই এখনও পৃথিবী ও জমি স্থির রয়েছে।’ (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক : ১৩৮৬)।
ঘুষ জঘন্য অপরাধ : ঘুষের আদান-প্রদান অত্যন্ত নিন্দনীয়, মন্দ, গর্হিত ও নিকৃষ্ট অপরাধ। ঘুষখোররা অত্যন্ত নির্লজ্জ ও বেহায়া হয়ে থাকে। চক্ষুলজ্জাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা পারিতোষিক গ্রহণ করে নেয়। বেতন সাপেক্ষে দায়িত্ব পালন করার পরও উৎকোচ নিতে বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করে না। তাদের এ কাজ জঘন্য ও কদর্যপূর্ণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, দৌড়ে দৌড়ে পাপে, সীমালঙ্ঘনে ও হারাম ভক্ষণে পতিত হয়। তারা অত্যন্ত মন্দ কাজ করছে।’ (সুরা মায়িদা : ৬২)। ঘুষ গ্রহণ অত্যন্ত ঘৃণ্য হওয়ায় একে কুফরির সঙ্গে তুলনা করে মাসরুক (রহ.) বলেন, ‘কোনো বিচারক যখন কোনো উপঢৌকন গ্রহণ করে, তখন সে হারাম খায়। আর যখন ঘুষ গ্রহণ করে, তখন কুফরি পর্যন্ত পৌঁছে যায়।’ (সুনানে নাসাঈ : ৫৬৬৫)। ঘুষের আদান-প্রদান অভিসম্পাতযোগ্য অপরাধ। আবদুল্লাহ ইবনে আস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ঘুষদাতা ও গ্রহীতাকে অভিসম্পাত করেছেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৫৮০)।
ঘুষ সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ : ঘুষ আদান-প্রদান করার কারণে সমাজে বহুমাত্রিক বিশৃঙ্খলা, বিনাশ, ধ্বংস ও বিপর্যয় নেমে আসে। ঘুষের বলে অযোগ্য ব্যক্তিরা যোগ্যতার আসনে আসীন হয়ে যায়। ফলে বহুবিধ অশুভ পরিণাম ও ভয়ঙ্কর পরিণতির সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপক আবশ্যক। এখন এ পদের যোগ্য ও অযোগ্য শত শত প্রার্থী রয়েছে। নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা নেওয়া হলে সবচেয়ে যোগ্যতম প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়ে অধ্যাপকের চেয়ারে সমাসীন হবেন। এতে হাজার হাজার ছাত্র উপকৃত হবে এবং আগামী দিনে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে। পক্ষান্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অফিসার বা রাজনৈতিক নেতাকে ঘুষ দিয়ে অসদুপায় অবলম্বন করার মাধ্যমে যদি কোনো ব্যক্তি অধ্যাপকের চেয়ার দখল করে নেয়, তাহলে হাজার হাজার ছাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরবর্তী সময়ে এ অযোগ্য ছাত্ররা দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। ফলে দেশ ও জাতি মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অথচ অযোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব গ্রহণকে হাদিস শরিফে কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন আমানত নষ্ট হয়ে যাবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমানত কীভাবে নষ্ট হবে?’ তিনি বললেন, ‘যখন কোনো দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির ওপর ন্যাস্ত করা হবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ (বোখারি : ৬৪৯৬)।
ঘুষখোরের দোয়া প্রত্যাখ্যাত : অন্যায়ভাবে হরণ বা আত্মসাৎকৃত সম্পদ হারাম। মহান আল্লাহ অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে নিষেধ করে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)। তাই যারা অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে, তারা হারাম কাজ করে। আর ঘুষখোররা অন্যের সম্পদ অনৈতিক পন্থায় আত্মসাৎ করে। এ হিসাবে তাদের হারামখোরও বলা যায়। আর হারামখোরদের দোয়া আল্লাহতায়ালা কবুল করেন না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধূলিমলিন। সে আসমানের দিকে হাত প্রলম্বিত করে বলে, ‘হে আমার রব! হে আমার প্রতিপালক!’ অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কীভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি : ২৯৮৯)।
ঘুষ জীবনের বোঝা : ঘুষ নেয়ার পর ঘুষখোর হয়তো সাময়িকভাবে আনন্দিত হয়। টাকার গরমে অনৈতিক ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। কিন্তু এ আনন্দ ও ভোগ-বিলাস ক্ষণিকের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘুষের টাকায় ঘুষখোরদের শান্তি অর্জিত হয় না। তাদের ঔরসে পঙ্গু বা বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নেয়। ঘুষখোরদের সন্তান-সন্তুতি মদ্যপ, বখাটে ও অবাধ্য হয়ে পিতামাতার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এ হলো ঘুষের পার্থিব শাস্তি। পরকালেও ঘুষের টাকা ঘুষখোরদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আবু হুমায়দ সাঈদি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে রাজস্ব আদায়কারী নিযুক্ত করলেন। সে কাজ শেষ করে তার কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা আপনার জন্য। আর এ জিনিসটি আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি তোমার বাবা-মায়ের ঘরে বসে থাকলে না কেন? তাহলে দেখতে, তোমার জন্য হাদিয়া পাঠানো হয় কি-না?’ এরপর রাসুল (সা.) এশার নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাশাহুদ পাঠ করে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, ‘রাজস্ব আদায়কারীর অবস্থা কী হলো? আমি তাকে নিযুক্ত করে পাঠালাম। আর সে আমাদের কাছে এসে বলছে, এটা সরকারি রাজস্ব। আর এ জিনিস আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে। সে তার বাবা-মায়ের ঘরে বসে থাকল না কেন? তাহলে দেখত, তার জন্য হাদিয়া দেওয়া হয় কি-না? ওই সত্তার কসম! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তোমাদের মাঝে কেউ কোনো বস্তুতে খেয়ানত করলে, কেয়ামতের দিন সে ওই বস্তুটিকে তার কাঁধে বহন করা অবস্থায় আসবে! সে বস্তুটি যদি উট হয়, তাহলে আওয়াজ করতে থাকবে। যদি গরু হয়, তাহলে হাম্বা হাম্বা করতে থাকবে। আর যদি বকরি হয়, তাহলে ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে।’ (বোখারি : ৬৬৩৬)।
ঘুষখোরদের ঠিকানা জাহান্নাম : ঘুষখোরদের জ্বালাতনে বহু মানুষ হয়রান, পেরেশান ও নাকাল হয়ে যায়। নিজের ন্যায্য কাজ করাতে গিয়ে বহুবিধ পেরেশানি ও কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হয়।
আর কোনো মুসলমানকে অকারণে হয়রান ও পেরেশান করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ঘুষখোররা যেমন অন্যদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে, ঠিক তেমনিভাবে তাদের জন্যও রয়েছে ইহকালীন লাঞ্ছনা ও পরকালীন বঞ্চনা। ঘুষখোররা মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে। আর যারা মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে, তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। খাওলা আনসারি (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কিছু লোক আল্লাহর দেয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে। কেয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত। (বোখারি : ৩১১৮)।