ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ব্যবসায়ীদের ইহ-পরকালীন সুফল কুফল

হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ। নবীজি (সা.) ও সাহাবিদের অনেকেই ব্যবসা করেছেন। যা আমাদের আদর্শ। তা ছিল ন্যায়-নীতি ও সত্যের। সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে ইহ-পরকালীন সুসংবাদ। তেমনি অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে ইহ-পরকালীন দুঃসবাদ। সৎপন্থায় ব্যবসা করলে তা দুনিয়া ও আখেরাতে সুফল বয়ে আনে। অসৎপন্থায় ব্যবসা করলে উভয় জগতের ব্যর্থতা ও কুফল রয়েছে। ব্যবসায়ীদের ইহ-পরকালীন সুফল ও কুফল প্রসঙ্গে লিখেছেন- মিজান ইবনে মোবারক
ব্যবসায়ীদের ইহ-পরকালীন সুফল কুফল

ধোঁকা না দেয়া : ব্যবসায় সৎ থাকা জরুরি। গ্রাহক যখন বুঝতে পারবে, বিক্রেতা সৎ, তখন পরবর্তীতে সে আবারও সেই দোকানে আসবে। এর মাধ্যমে তার ব্যবসার উন্নতি সাধন ঘটবে। বিক্রেতা অসৎ হলে পরবর্তীতে সে ওই দোকানদারের ধারে ঘেঁষবে না। এটা ব্যবসায়ীর জন্য ক্ষতির কারণ হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি খুব?ই অপছন্দনীয়। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একদিন রাসুল (সা.) বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি খাদ্যের ভেতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন, ভেতরের খাদ্যগুলো ভেজা বা নিম্নমান। এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে খাবারের পণ্যের মালিক! এটা কী?’ লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টি পড়েছিল।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি সেটাকে খাবারের ওপর রাখলে না কেন, যাতে লোকেরা দেখতে পেত? যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম : ১০২)।

মিথ্যা না বলা : একজন মোমিনের অত্যাবশকীয় গুণ হলো, সত্য বলা। সত্য সব সময়ই সুন্দর। মিথ্যা কেউই পছন্দ করে না। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেকেই মিথ্যা বলে বিক্রি করে। যা মোটেই উচিত নয়। মিথ্যা বলা কবিরা গোনাহ। রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘একজন মোমিন কি ভীরু হতে পারে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মোমিন কি কৃপণ হতে পারে?’ বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর জিজ্ঞেস করা হলো, ‘একজন মোমিন মিথ্যুক হতে পারে?’ বললেন, ‘না।’ (সুনানে বাইহাকি : ৪৮১২)। মিথ্যা বলার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! মিথ্যা কথা পরিহার কর। নিশ্চয় মিথ্যা পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়। আর পাপাচার জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়। মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে, অবশেষে সে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হয়।’ (মুসলিম : ২৬০৭)।

ওজনে কম না দেয়া : সঠিক ওজনে ক্রেতার কাছে পণ্য হস্তান্তর করা বিক্রেতার কর্তব্য। কোর?আনুল কারিমে এ মর্মে বিভিন্ন জায়গায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালার নবী শুয়াইব (আ.) তার জাতিকে সঠিকভাবে পরিমাপের নির্দেশ দিয়েছেন। যারা ওজনে সঠিক পরিমাপ করে, তাদের জন্য রয়েছে ইহকাল ও পরকালে শুভ পরিণাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মেপে দেবে এবং সঠিক পাল্লায় ওজন করবে। এটি উত্তম, এর পরিণাম শুভ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৫)। যারা এতে ক্ষতিসাধন করে, কোরআনুল কারিমে তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের কথা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা পরিমাপে কম দেয়, তাদের জন্য ধ্বংস।

যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে; আর যখন তাদের মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩)। বেচাকেনার মাধ্যমে পরস্পরের হক সাব্যস্ত হয়। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী ওজনে কম দেয়ার ফলে ক্রেতার হক নষ্ট করেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য কারও ক্ষতিসাধন করে, আল্লাহতায়ালা তা দিয়েই তার ক্ষতিসাধন করেন। যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয়, আল্লাহতায়ালা তাকে কষ্টে ফেলেন।’ (তিরমিজি : ১৯৪০)।

কোমল ব্যবহার করা : যেসব বিক্রেতা কোমল ব্যবহার করে, ক্রেতাদের তাদের দোকানের প্রতি ঝোঁক থাকে। এতে তার দোকানের বেচাকেনা ধীরে ধীরে উন্নতি হতে থাকে। পক্ষান্তরে যে কোমল আচরণের অধিকারী হয় না, ক্রেতারা তার দোকান থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। দিনকে দিন তার ব্যবসার অবনতি হতে থাকে। যারা কোমল আচরণ করে, ক্রেতার প্রতি সদয় থাকে, নবীজি (সা.) তাদের জন্য দোয়া করেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যে বিক্রির সময়, ক্রয়ের সময় এবং অভিযোগের সময় সদয় থাকে।’ (বোখারি : ২০৭৬)।

মিথ্যা কসম না করা : অনেকে মিথ্যা বলে বিক্রি করে। এরপর মিথ্যাকে জোরদার করার জন্য এর ওপর শপথ করে। অথচ মিথ্যাবাদীর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে সাময়িক বিক্রি হলেও পরবর্তীতে তা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি ভয়াবহ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামত দিবসে আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো, যে তার ব্যবসায়িক পণ্য মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।’ (মুসলিম : ১০৬)।

সুদের কারবার না করা : অনেকে পণ্য দিয়ে দোকান ভর্তি করার জন্য সুদে টাকা নেয়। অথচ সুদ সম্পূর্ণ হারাম। এতে যদিও দেখা যায় অনেক, কিন্তু পরিণামে রয়েছে খুবই স্বল্পতা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সুদ যদিও বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৭৯)। আবার অনেকে নগদ বিক্রির সময় নির্ধারিত মূল্য রাখে; কিন্তু বাকিতে বিক্রির সময় অথবা কিস্তিতে বিক্রির সময় অতিরিক্ত টাকা রাখে। এটাও সুদ। অথচ অনেকে এটা জানেই না। সুদের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা কেয়ামতের দিন দণ্ডায়মান হবে শয়তানের আসরে মোহাবিষ্টদের মতো। কারণ, তারা বলে, ব্যবসাও তো সুদের মতো। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।

ক্রেতাকে বাধ্য না করা : অনেক সময় বিক্রেতা এমন কথায় ক্রেতাকে আটকায় যে, এক প্রকার বাধ্য হয়েই তখন তার ক্রয় করতে হয়। অথচ এটা সম্পূর্ণ হারাম। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির সম্পদ তার সন্তুষ্টি ছাড়া হালাল নয়।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)।

দালালি না করা : বাজারঘাটে এমন অনেক লোক আছে, যাদের পণ্য কেনার মোটেও ইচ্ছা নেই; কিন্তু অন্য লোকে যাতে ওই পণ্য বেশি দামে কিনতে উদ্বুদ্ধ হয়, সেজন্য পণ্যের পাশে ঘোরাঘুরি করে এবং দাম বাড়িয়ে বলতে থাকে। এটাই প্রতারণামূলক দালালি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ক্রেতার ভান করে তোমরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিও না।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ৫০২৮)।

মজুদে সংকট তৈরি না করা : অনেকে খাদ্য মজুত করে রাখে। যখন সংকট তৈরি হবে, তখন তারা তা বেশি দামে বিক্রি করার আশা রাখে। এটা সম্পূর্ণ হারাম। কোনো মোমিন ব্যবসায়ী এমন কাজ করতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাপী ব্যক্তিই মজুতদারি করে।’ (মুসলিম : ১৬০৫)। এমন মজুতকারীর জন্য পরকালে রয়েছে যেমন শাস্তি, ইহকালেও রয়েছে এর জন্য তেমন চরম দুর্ভোগ, হতাশা ও যন্ত্রণা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৩৮)।

সেবার মাধ্যমে ইবাদত : ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে নিছক লাভ করা হয়, তা নয়; বরং তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে তাদের সাহায্য করাও হয়, সেবা প্রদান করা হয়। পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করা হয়। এতে সমাজে মানুষের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদান হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর।’ (সুরা মায়িদা : ২)।

সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য সুসংবাদ : ব্যবসা আল্লাহর ইবাদতের প্রতিবন্ধক নয়; বরং ইবাদত রিজিক বৃদ্ধির কারণ। যারা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে না, তাদের ব্যবসায় বরকত থাকে না। আল্লাহতায়ালা মোমিন ব্যবসায়ীদের গুণাগুণ সম্পর্কে বলেন, ‘এমন লোকেরা, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহর স্মরণ থেকে, সালাত কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিগুলো উল্টে যাবে। তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে, যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিজিক দান করেন।’ (সুরা নুর : ৩৭-৩৮)। যারা ব্যবসায় অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকে, সৎপথ অবলম্বন করে, তাদের জন্য রয়েছে নবীজি (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ীগণ বিচার দিবসে নবী, অলি ও শহিদদের সঙ্গে অবস্থান করবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)।

ভেজাল পরিহার করা : ব্যবসায় বর্তমানে ভেজালের ছড়াছড়ি। ক্রেতারা আসল পণ্যটির জন্য মুখিয়ে থেকেও ভেজাল থেকে বাঁচতে পারে না। বিক্রেতারা অধিক লাভের আশায় ভেজাল মিশ্রিত দ্রব্য বিক্রি করে। এতে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। তাদের ক্ষতিসাধন করা হয়। যা সম্পূর্ণ হারাম। তারা মনে করে, আমরা তো খাব না, অন্য মানুষে খাবে। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুহাম্মদণ্ডএর প্রাণ যার হাতে, তাঁর কসম! তোমাদের কেউ পূর্ণ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না সে নিজের ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে থাকে।’ (সুনানে নাসায়ি : ৫০১৭)।

অসৎ ব্যবসায়ীদের পরিণাম : রাসুল (সা.) লোকদের কেনাবেচায় জড়িত দেখে বললেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়!’ তারা রাসুল (সা.)-এর ডাকে সাড়া দিল। নিজেদের ঘাড় ও চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। তিনি বললেন, ‘কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদের ফাসেক বা গোনাহগাররূপে তোলা হবে। কিন্তু যেসব ব্যবসায়ী আল্লাহকে ভয় করে, নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং সততা ধারণ করে, তারা এর ব্যতিক্রম।’ (তিরমিজি : ১২১০)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত