ইসলামে সুশাসন ও ন্যায়পরায়ণতা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নিরাপত্তা বিধানে ন্যায়বিচার ও সুশাসন অপরিহার্য। মানবিকতা, ন্যায়নীতি ও সুবিচার ইসলামের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মানবজীবনে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআনে আল্লাহর পরিচয় দেয়া হয়েছে, ‘তিনি বিচার দিবসের মালিক।’ (সুরা ফাতিহা : ৩)। আল্লাহর একটি নাম ‘হাকিম’ বা ন্যায়বিচারক। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক নন।’ (সুরা তিন : ৮)। তিনি আরো বলেন, ‘তিনিই শ্রেষ্ঠ বিচারক।’ (সুরা ইউসুফ : ৮০)। ন্যায়ের বিধান সর্বকালের ও সব সমাজের জন্য কাম্য। সব আসমানি কিতাবে এ নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম; তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো; নবীরা আল্লাহর অনুগত ছিল। তারা ইহুদিদের সে অনুসারে বিধান দিত।

আরো বিধান দিত রব্বানিগণ ও বিদ্বানগণ। কারণ, তাদের আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল। তারা ছিল তার সাক্ষী। সুতরাং তোমরা নির্বোধ লোকদের ভয় করো না। শুধু আমাকেই ভয় কর। আমার আয়াতের বিনিময়ে সামান্য সম্পদ ক্রয় করো না। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফের। আমি তাদের জন্য এতে বিধান দিয়েছিলাম- প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ জখম। এরপর কেউতা ক্ষমা করলে তাতে তারই পাপ মোচন হবে। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই জালেম। ইঞ্জিল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুসারে বিধান দেয়। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই ফাসেক।’ (সুরা মায়িদা : ৪৪-৪৭)।

ইসলামি বিধানের উদ্দেশ্য : ইসলামি বিধানের উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ তথা জীবন সুরক্ষা, সম্পদ সুরক্ষা, জ্ঞান সুরক্ষা, বংশপরম্পরার পবিত্রতা সুরক্ষা এবং এসবের মাধ্যমে ধর্ম সুরক্ষা। হাশরের দিন যারা আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবেন, তাদের মধ্যে প্রথম হলেন ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক’। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাত ধরনের ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা তাঁর (আরশের) ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। তারা হলো- ন্যায়বান শাসক, আল্লাহর ইবাদতে আনন্দ পাওয়া যুবক, ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে যুক্ত থেকে বের হওয়ার পর ফিরে আসা পর্যন্ত, এমন দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য একে অন্যকে ভালোবাসে, এরই ওপর একত্র হয় এবং এরই ওপর পৃথক হয়, এমন ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (অন্যায়) আহ্বান করলেও সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, এমন লোক যারা এমন গোপনে দান করে, তার ডান হাত কী দান করল তা তার বাঁ হাত জানতে পারে না, আর ওই ব্যক্তি যে নির্জন-নিভৃতে আল্লাহকে স্মরণ করে তার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।’ (বোখারি : ৬৬০, মুসলিম : ১০৩১)।

সুবিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ : মানুষের মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ইসলামি বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কোরআন-সুন্নাহে এ সম্পর্কে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামে সুবিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ, সদাচার ও নিকটাত্মীয়দের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন; যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সুরা নাহল : ৯০)। এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা তিনটি বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন। তা হলো- সুবিচার, অনুগ্রহ ও আত্মীয়দের প্রতি অনুগ্রহ। পক্ষান্তরে তিন প্রকার কাজ করতে নিষেধ করেছেন। অশ্লীলতা, যাবতীয় মন্দ কাজ এবং জুলুম ও উৎপীড়ন। ইমাম রাগিব ইস্পাহানি (রহ.) বলেন, আদল অর্থ বিচারের ক্ষেত্রে কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব না করে সমান সমান করা। অর্থাৎ ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ নীতিতে বিচারকার্য সম্পাদন করা। শায়খ আবুল বাকা (রহ.)-এর মতে, আদল শব্দটি জুলুমের বিপরীত। এর অর্থ হলো, যার যা প্রাপ্য যথাযথভাবে তাকে তা দেয়া।

সত্যের পক্ষে সাক্ষ্যদান : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাক্ষ্যদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ইসলামি শরিয়তে সাক্ষীর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার শর্তারোপ করা হয়েছে। ইনসাফপূর্ণ ফয়সালা করতে সাক্ষ্য গ্রহণে বিচারককেও সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা, ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থেক। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাক্ষ্য দাও। এমনকি সেই সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের অথবা মা-বাবার অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গেলেও। যার সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়া হচ্ছে, সে ধনী হোক বা গরিব, আল্লাহই উভয়ের সর্বোত্তম অভিভাবক। প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। যাতে তোমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পার। আর তোমরা যদি প্যাঁচানো কথা বল বা সত্যকে এড়িয়ে যাও, তবে মনে রেখ, তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ পুরোপুরি জানেন।’ (সুরা নিসা : ১৩৫)।

শাসন ও ন্যায়বিচার : মানুষের অধিকার ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রতি জোর দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থেক। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর। এটি আল্লাহভীতির নিকটতর। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে খবর রাখেন।’ (সুরা মায়িদা : ৮)। ইসলামি বিধানমতে, সমাজে ন্যায়বিচারের ধারা অব্যাহত রাখা ফরজে কেফায়া। মুসলিম সমাজের একটি অংশ মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকলে অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যাবেন। নইলে সমাজে সবার ওপর ফরজ ত্যাগের দায় বর্তাবে। নবী দাউদ (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে দাউদ, নিশ্চয় আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে যথাযথভাবে বিচার কর।’ (সুরা সোয়াদ : ২৬)।

আদর্শ বিচারকের বৈশিষ্ট্য : ন্যায়বিচারের সুফল যাতে জনগণ ভোগ করতে পারে, সে লক্ষ্যে ইসলাম বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। বিচারকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, বিচারপ্রার্থীকে তার কাছে পৌঁছাতে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ বিচারকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা- ১. বিচারক যেখানেই বিচার করুন না কেন, সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশের অনুমতি থাকতে হবে। ২. কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের উপহার নিতে পারবেন না। ৩. কারো বিশেষ দাওয়াতে অংশ নিতে পারবেন না।

৪. সব বিষয়ে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের প্রতি সমতা নিশ্চিত করতে হবে। ৫. কোনো এক পক্ষের সঙ্গে গোপন আলাপ, উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলা, মুখোমুখি হাসা, তাদের সম্মানার্থে দাঁড়ানো ইত্যাদি আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ৬. বিচারের মঞ্চে বসে ঠাট্টা-মশকরা করা যাবে না। ৭. আদালতে বিচারকের সামনে কোনো পক্ষই এমন কথা বলতে পারবে না, যা অন্য পক্ষ বুঝতে অপারগ। (ফতোয়ায়ে শামি, কিতাবুল কাজা)।

বিচারকের অনন্য মর্যাদা : ন্যায়পরায়ণ বিচারকের অনন্য মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। কোরআনে বিচারকাজকে নবী-রাসুলদের কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা নিজেই ন্যায়পরায়ণ বিচারকদের ভালোবাসার কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন তুমি বিচার কর, তখন তাদের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়িদা : ৫)। বিচারককে ন্যায়বিচার করার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। তারপরও তার সিদ্ধান্তে ভুল হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে দোষণীয় নয়। সিদ্ধান্ত সঠিক হোক কিংবা ভুল, আল্লাহ তাকে ন্যায়নিষ্ঠার প্রতিদান অবশ্যই দান করবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো বিচারক যখন বিচার করেন এবং বিচারকাজে (সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে) যথাযথ প্রচেষ্টা চালান। তার রায় সঠিক হয়, তবে তার জন্য দুটি নেকি থাকে। আর তিনি যখন বিচার করেন এবং বিচারকাজে যথাযথ প্রচেষ্টা চালান (ইজতিহাদ করেন) আর তার রায় ভুল হয়, তবে তার জন্য একটি নেকি লেখা হয়।’ (বোখারি : ৭৩৫২)।

পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকের পরিণাম : ইসলামে বিচারকের মর্যাদা ঘোষণার পাশাপাশি সতর্কও করা হয়েছে। কারণ, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সমাজের অন্যতম স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আইনের যথাযথ প্রয়োগে বিচারকদের চৌকস সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিচারকার্যের স্পর্শকাতরতা উল্লেখ করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যাকে মানুষের মধ্যে বিচারক বানানো হলো, তাকে ছুরি ছাড়া জবাই করা হলো।’ (তোহফাতুল আহওয়াজি : ৪/৫০৫)। বিচারকাজে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া এবং অন্যায় ফয়সালা করা পরকালে কঠিন শাস্তির কারণ।

বিচারকরা তিন দলে বিভক্ত। একদল জান্নাতি এবং দুই দল জাহান্নামি। যে বিচারক সত্য জেনে সেই মোতাবেক ফয়সালা করে, সে জান্নাতি। আর যে সত্য জানা সত্ত্বেও রায় প্রদানে অন্যায়ের আশ্রয় নেয়, সে জাহান্নামি। আর যে ব্যক্তি অজ্ঞ অবস্থায় বিচারকাজ সম্পাদন করে, সেও জাহান্নামি। তাই মূর্খ ও অযোগ্যদের বিচারক পদ গ্রহণ করা বৈধ নয়। বিশেষত বিচারকাজে নিযুক্ত ব্যক্তি অবশ্যই কোরআন-সুন্নাহ, ইসলামি আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পূর্ববর্তী আলেমদের মতামত এবং কিয়াস (অন্য বিধানের আলোকে বিধান উদ্ভাবন) করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা জরুরি।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী