ঢাকা শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থ সংকট দূরীকরণে নির্দেশনা

ইসলাম দরিদ্রতাকে মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর সমাধানে দিয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে অর্থ সংকট দূরীকরণের কিছু নির্দেশনা তুলে ধরেছেন- যোবায়ের ইবনে ইউসুফ
অর্থ সংকট দূরীকরণে নির্দেশনা

রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টন : রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টন দারিদ্র্য বিমোচনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। এটি সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি একটি উন্নত ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনে সহায়ক।

তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেন শুধু এলিট শ্রেণির লোকদের মধ্যেই পুঞ্জিভূত না হয়ে যথাযথভাবে বণ্টন হয়, সেজন্য ইসলাম দিয়েছে কঠোর বিধান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জনপদবাসীদের কাছ থেকে আল্লাহ তাঁর রাসুলকে যা (সম্পদ) দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রাসুলের, তার আত্মীয়-স্বজনের, এতিমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্য।

যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জিভূত না হয়। রাসুল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক। আল্লাহকে ভয় কর।

নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা হাশর : ৭)। রাসুল (সা.) এবং তার পরে খোলাফায়ে রাশেদিন এ আয়াত মোতাবেক সম্পদ বণ্টন করেছেন। তাই তাদের যুগ কেয়ামত পর্যন্ত দারিদ্র্য বিমোচনের সোনালি যুগ হিসেবে রোল মডেল হয়ে থাকবে।

সুদ নিষিদ্ধ করা : ঋণের বিনিময়ে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে যে অর্থ বা সুবিধা গ্রহণ করা হয়, তাকে সুদ বলে। দারিদ্রের অন্যতম কারণ এ সুদ। দরিদ্ররা অনেক সময় তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ বা সমস্যা নিরসনের জন্য ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এ ঋণের ওপর যখন উচ্চহারে সুদ আরোপ করা হয়, তখন তারা সহজে তা পরিশোধ করতে পারে না। ফলে বাধ্য হয়ে আবার নতুন ঋণ নেয়। এভাবে তারা এক সময় ঋণের চক্রে আটকা পড়ে যায়। সৃষ্টি হয় দারিদ্রের মতো চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের। সুদের মাধ্যমে ধনীশ্রেণি আরো ধনী হয়। অন্যদিকে দরিদ্রশ্রেণি সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে হয়ে পড়ে আরো নিঃস্ব। অর্থনৈতিক এ অরাজকতা যেন সৃষ্টি হতে না পারে, সেজন্য ইসলাম সুদকেই নিষিদ্ধ করেছে কঠোরভাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সুদ খায়, (কেয়ামতের দিন) তারা সেই ব্যক্তির মতো উঠবে, শয়তান যাকে স্পর্শ দ্বারা পাগল বানিয়ে দিয়েছে। এটা এজন্য হবে যে, তারা বলেছিল, ব্যবসাও তো সুদেরই মতো। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।

সুদখোরের শাস্তি : সুদ হারাম হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও যারা সুদের সঙ্গে জড়িত হবে, তাদের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা তা (সুদ) ত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শোন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৯)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ সুদখোর, সুদদাতা, সুদের সাক্ষী এবং যে এর চুক্তি লিখে, তাদের সবাইকে অভিসম্পাত করেছেন।’ (মুসলিম : ১৫৯৮)।

অলসতা পরিত্যাগ : প্রবাদ আছে, ‘পরিশ্রমে ধন আনে, পুণ্যে আনে সুখ; অলসতা দারিদ্র আনে, পাপে আনে দুঃখ।’ এ প্রবাদের সত্যতা অনস্বীকার্য। আসলেও তো অলসতা মানুষের জীবনে অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়, দারিদ্র্যের মূল কারণ। তাই ইসলামে অলসতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। রাসুল (সা.) অলসতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। তিনি প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অক্ষমতা এবং অলসতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (বোখারি : ৬৩৬৭)।

শ্রমণ্ডসাধনা : ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রম পরিত্যাগ করে মানুষ যেন দারিদ্র্যের মুখে পতিত না হয়, সেজন্য ইসলাম পরিশ্রম এবং কর্মোদ্যমতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনও কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।’ (বোখারি : ২০৭২)। এখানেই শেষ নয়। ইসলাম মানুষকে কর্মদক্ষ এবং কঠোর পরিশ্রমী হওয়ার জোর তাগিদ দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ রশি নিয়ে পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে, তা বাজারে বিক্রি করে জীবনযাপন করে, তা তার জন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করার চেয়ে উত্তম।’ (বোখারি : ১৪৭১)।

সামাজিক দায়িত্ববোধ : ইসলাম সকল মানুষকে যার যার অবস্থান অনুযায়ী কিছু না কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সবাই যেন নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, সেজন্য সতর্কও করেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শোন! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বোখারি : ২৩৮৬)। সমাজের বিত্তশালীদের দায়িত্ব হলো, দরিদ্রদের সাহায্য-সহযোগিতা করা; দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সামর্থ্যানুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর দরিদ্রদের দায়িত্ব হলো, আল্লাহর ওপর ভরসা করে, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে যাওয়া। ইসলামি নির্দেশনা মেনে যদি সবাই নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে অবশ্যই সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে, বিমোচন হবে দারিদ্র্য।

দুর্নীতি দমন : দুর্নীতি দমন দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অপরিহার্য। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সুশাসন এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন সমাজে দুর্নীতি থাকবে না, তখনই কেবল দরিদ্ররা তাদের অধিকার ফিরে পাবে।

একটি সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে উঠবে। এ কারণেই ইসলাম সর্বদা সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। আয়েশা (রা.) বলেন, মাখজুম গোত্রের এক নারীর চুরির ঘটনা কোরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। তারা বলাবলি করতে লাগল, কে এ ব্যাপারে (শাস্তি ম?ওকুফের ব্যাপারে) আল্লাহর রাসুলের সঙ্গে কথা বলার সাহস রাখে। অগত্যা তারা বলে উঠল, উসামা বিন জায়েদ (রা.) ছাড়া আর কে এ সাহস রাখে! সে তো আল্লাহর রাসুলের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। এরপর উসামা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেন। (তার কথা শুনে) রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ?’ তারপর রাসুল (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবায় বললেন, ‘তোমাদের আগের জাতিগুলোকে এ কাজই ধ্বংস করেছে। তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট লোক যখন চুরি করত, তখন তারা তাকে বিনা সাজায় ছেড়ে দিত। অন্যদিকে কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক যখন চুরি করত, তখন তার ওপর তারা শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমা?ও চুরি করত, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত?ও কেটে দিতাম।’ (বোখারি : ৩৪৭৫)।

নৈতিক উন্নয়ন : ইসলাম নৈতিক উন্নয়নকে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে। কারণ, নৈতিক উন্নয়ন ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, লেনদেন ও আচার-আচরণকে নিষ্কলুষ করে। শিক্ষা দেয় ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। ফলে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে আসে ইতিবাচক পরিবর্তন। ব্যক্তি তখন অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন?ও করে না, অপব্যয়ও করে না। বন্ধ হয়ে যায় সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ। এজন্যই ইসলাম নৈতিক উন্নয়নকে সকল কিছুর ওপর অগ্রাধিকার দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখ, শরীরে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়, গোটা শরীর খারাপ হয়ে যায়। শোন, সে গোশতের টুকরোটি হলো কলব।’ (বোখারি : ৫২)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, অভ্যন্তরীণ দিক তথা নৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই বাহ্যিক সফলতা অর্জন হয়। অতএব, বলা যায়, নৈতিকতার উন্নয়ন?ই একটি দারিদ্র্যমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের মূল চাবিকাঠি।

লেখক : ইমাম ও খতিব, ফুকুরহাটি মধ্যপাড়া জামে মসজিদ, ভাঙ্গা, ফরিদপুর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত