মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য বিশেষ নেয়ামত। এটি সংযম, নাজাত ও পাপমুক্তির মাস। অথচ এ মাস এলে আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা যেন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর রমজান এলে জনগণকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয়। জনজীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক। রমজান নাজাতের মাস হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়ায় আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ, তোমরা পরস্পর তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না। তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর নিজেদের হত্যা কোরো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান।’ (সুরা নিসা : ২৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা কেউ কারো ওপর জুলুম কোরো না। কারো সম্পদ তার মনের সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কারো জন্য হালাল নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২০৬৯৫)।
কৃত্রিম সংকট তৈরি করা মহাপাপ : মাসব্যাপী চলা রোজার মাসে ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও সামগ্রিক জীবনধারায় পরিবর্তন হয়। স্বভাবতই রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। একে পুঁজি করে প্রতি বছর অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুতদারের আবির্ভাব ঘটে। তাদের সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যোগ হয়। পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না; কিন্তু এসব অসাধু সিন্ডিকেটের যোগসাজশে ও মজুতদারির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট হয়। ফলে মূল্য বাড়ে। তারা লুটে নেয় অধিক হারে মুনাফা। সীমিত আয়ের জনগণের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) এদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘(সাবধান!) পাপাচারী ছাড়া অন্য কেউ মজুদদারি করে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৪)।
সংকট তৈরির শাস্তি ভয়াবহ : রমজান এলে কৃত্রিম সংকট তৈরিকারীদের কাছে জনগণ জিম্মি থাকে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের কাছে যা এক ধরনের মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। খেটে খাওয়া, দিনমজুর ও যাদের দৈনিক বা মাসিক আয় নির্দিষ্ট, পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। রমজানে এসব মানুষের আয় বাড়ে না; বরং অনেকের আরও কমে যায়।
পরকালে এসব কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে। দুনিয়ায়ও এমন ব্যক্তি আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিনের খাদ্যপণ্য মজুত রাখে, সে আল্লাহর দেওয়া নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২০৩৯৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৩৮)। অপরদিকে প্রতারণা, সিন্ডিকেট, মজুতদারি ইত্যাদি না করে সৎভাবে ব্যবসা করার অনেক ফজিলত ও মর্যাদার কথা হাদিসে এসেছে। সৎ ব্যবসায় বরকত ও প্রতারণায় অভিশাপ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত এবং পণ্য মজুতদার অভিশপ্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৩)।
মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা পাপের শামিল : অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি মনোভাব প্রচলিত আছে, রমজানের এক মাস ব্যবসা করব; বাকি সারা বছর আরামে কাটাব।
ফলে তারা রমজান মাসে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে চায়। দাম বাড়ানোর প্রশ্নে খুচরা বিক্রেতারা দোষ চাপায় পাইকারি বিক্রেতাদের ওপর। পাইকারি বিক্রেতারা দোষ চাপায় আমদানিকারকদের ওপর। আবার আমদানিকারকরা কারণ হিসেবে আমদানি মূল্য, পরিবহন ব্যয় ও চাঁদাবাজির দোহাই দেয়।
এভাবে একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা, সেটি এক প্রকার দায়হীনতার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আবার ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে মূল্য বাড়ালেও আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য কমলে বাড়ানো দাম আর কমায় না। রহমতের মাস রমজান এলে বিশ্বের বেশির ভাগ মুসলিমপ্রধান দেশে যেখানে দ্রব্যমূল্যের দাম কমানো হয়, সে তুলনায় আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় অযথা খাদ্য মজুত করার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুর্নীতিপরায়ণ ছাড়া কেউ মজুতদারি করে না।’ (তিরমিজি : ১২৬৭)। ইসলামে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ে নিষেধ করা হয়েছে। মজুতদারদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (সংকট তৈরি করতে) খাদ্যশস্য গুদামজাত করে, সে গোনাহগার।’ (মুসলিম : ১৬০৫)।
মজুদ রাখার কঠোর পরিণাম : দেশে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদক এবং ভোক্তার মধ্যে দামের বিস্তর ফারাক। কৃষক যে মূল্যে পণ্য বিক্রি করে, তার কয়েকগুণ বেশি মূল্য দিয়ে ভোক্তাকে ওই একই পণ্য কিনতে হয়। মধ্যখানে এ কয়েকগুণ অতিরিক্ত মুনাফা যাচ্ছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতকারীর পকেটে।
এসব অসাধু সিন্ডিকেট ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার এবং প্রশাসন মাঠে সক্রিয় থাকলেও বাস্তবে তার কোনো ফলাফল দেখা যায় না। মূল্য বাড়তেই থাকে। নানা বৈঠক, আলাপ-আলোচনা হলেও সেগুলো শুধু খাতাকলম এবং চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে যায়। ব্যবসায় দালাল এমন চক্র, যারা দাম বাড়ানোর জন্য ক্রেতা-বিক্রেতার লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে। সিন্ডিকেট তৈরি করে প্রান্তিক কৃষকদের ঠকায়। বাজারে মালামাল এনে ক্রেতাদের বোকা বানায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতদের এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করেছেন। সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে দিতে বলেছেন, ‘বাজারের বাইরে গিয়ে কেনাবেচা করার জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করবে না। পশুর স্তনে দুধ জমিয়ে রাখবে না। দালালি কিংবা অপকৌশল করে পণ্যের দাম বাড়াবে না।’ (তিরমিজি : ১২৬৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও সতর্ক করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুত রাখে, আল্লাহতায়ালা তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫৫)।
সচেতনতা ও কার্যকরী পদক্ষেপ প্রয়োজন : প্রতি বছর রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার নানা রকম অঙ্গীকার করে থাকে। কিন্তু বরাবর দেখা যায়, কোনো এক অজানা কারণে বাজারের নাটাই সরকারের হাতে থাকে না। নাটাই থাকে কোনো এক অশুভ ব্যবসায়ী চক্রের হাতে। ফলে তারা সরকারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি মেনে চলে না।
ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে। রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। যদিও এটি প্রশংসার দাবিদার; কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় তা পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজরদারির পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। দোষীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দেশে কোনো পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী ঘাটতি থাকলে আগাম সেটি আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। টিসিবির পণ্যের বরাদ্দ ও বিক্রয়কেন্দ্র বাড়াতে হবে। সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণকেও ভোক্তার অধিকার বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী