মজুত করার ফলে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে সংকট দেখা দেয়। পণ্যদ্রব্যের মূল্যে স্ফীতি ঘটে। মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তাদের সুবিধা হয়। কিন্তু সাধারণ ক্রেতাসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই মুক্তবাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার উদ্দেশে খাদ্যদ্রব্যে মজুত করতে বিভিন্ন হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেছেন, ‘আমাদের বাজারে কেউ মজুত করবে না। যেসব লোকের হাতে অতিরিক্ত মুদ্রা রয়েছে, তারা যেন আল্লাহপ্রদত্ত জীবিকাগুলো হতে কোনো জীবিকা ক্রয় করে আমাদের ওপর মজুতদারি করার ইচ্ছা না করে। আর যে ব্যক্তি শীত মৌসুমে ও গ্রীষ্মকালে নিজের পিঠে বোঝা বহন করে খাদ্যশস্য আনবে, সে ওমরের মেহমান। সে যেরূপ ইচ্ছা বিক্রয় করুক, যেরূপ ইচ্ছা মজুত করুক।’ (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক : ১৩২৩)।
কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যের শাস্তি : মজুতদার ব্যক্তি অন্যের সুবিধা ও অসুবিধার কথা চিন্তা না করে খাদ্যদ্রব্যে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সে শুধু নিজের লাভ ও উপকারিতা দেখতে চায়, অন্যের উপকারিতা দেখতে চায় না। সে এ পন্থায় টাকা উপার্জন করে সুখ-শান্তির অধিকারী হতে চায়। কিন্তু সুখ-শান্তির চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে। মজুতদার যদিও সাময়িকভাবে টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদের মালিক হয়, কিন্তু তার পরিণাম সুখকর হয় না। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী মজুতদার দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হওয়া ও কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের সমাজে খাদ্যদ্রব্য মজুতদারি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যতার কষাঘাতে শাস্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৫)। অন্য একটি হাদিসে মজুতদারকে রিজিকবঞ্চিত ও অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমদানি পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুতদার অভিশপ্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৩)।
আগুনে বসানো : রক্ত-মাংসের মানুষের পক্ষে আগুনে বসা সহজ নয়। তাও যদি হয় জাহান্নামের আগুন, তাহলে এর ভয়াবহতা আরও বেড়ে যায়। যদি কোনো ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলে, তাহলে আল্লাহতায়ালা এমন মজুতদার ব্যবসায়ীকে জাহান্নামের আগুনে বসাবেন। হাসান (রা.) বর্ণনা করেন, মাকাল ইবনে ইয়াসার (রা.) অসুস্থ হলে উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ তার সেবা-শুশ্রƒষার জন্য গিয়ে বলেন, ‘হে মাকাল! তুমি কি জানো যে, আমি অন্যায়ভাবে কারও রক্তপাত ঘটিয়েছি?’ তিনি বললেন, ‘না, আমি জানি না।’ উবাইদুল্লাহ আবার বললেন, ‘তুমি কি জানো যে, আমি মুসলমানদের জন্য পণ্যের মূল্য নির্ধারণে কোনো হস্তক্ষেপ করেছি?’ মাকাল (রা.) বললেন, ‘না, তাও আমি জানি না।’ এরপর তিনি বললেন, ‘তোমরা আমাকে বসাও।’ তাকে বসানো হলে তিনি বললেন, ‘হে উবাইদুল্লাহ! আমি তোমাকে এমন একটি বিষয় শোনাব, যা মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে এক-দু’বার শুনিনি। আমি তাকে বহুবার বলতে শুনেছি, পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়ার লক্ষে যারা এতে হস্তক্ষেপ করে, আল্লাহতায়ালার অধিকার হলো, তাদেরকে কেয়ামতের দিন আগুনের মধ্যে বসানো।’ উবাইদুল্লাহ (রা.) বললেন, ‘তুমিই কি রাসুল (সা.)-এর মুখ থেকে এটা শুনেছ?’ মাকাল বললেন, ‘এক-দু’বার নয়; বহুবার শুনেছি।’ (মুসনাদে আহমদ : ২০৩১৩)।
দুর্নীতিপরায়ণ ও পাপাচারী : মজুতদার ব্যক্তি এমন দুর্ভাগ্য ও হতভাগা যে, চিরকালের জন্য দুর্নীতিপরায়ণ ও পাপিষ্ঠ হওয়ার কলঙ্ক-তিলক তার ললাটে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় মজুতদার ব্যবসায়ীকে দুর্নীতিপরায়ণ ও পাপিষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) মজুতদার ব্যবসায়ীকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে উল্লেখ করেছেন মর্মে মামার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে নাজলা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘দুর্নীতিপরায়ণ মানুষই মজুতদারি করে।’ (তিরমিজি : ১২৬৭)। অন্য আরেকটি হাদিসে গুদামজাতকারী ব্যক্তিকে পাপাচারী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। মামার (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘গুদামজাতকারী ব্যক্তি পাপাচারী।’ (মুসলিম : ৪০১৪)।
দায়মুক্তির ঘোষণা : মানুষ সবসময় আল্লাহতায়ালার দয়া ও করুণার মুখাপেক্ষী। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার দয়া ও করুণা হতে বঞ্চিত হয়, তাহলে তার চেয়ে হতভাগ্য আর কেউ হতে পারে না। বিশ্বনবী (সা.) যদি কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার দায়মুক্তির ঘোষণা করেন, তাহলে এমন ব্যক্তি মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা হতে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমন ব্যক্তির জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র। একটি হাদিসে মজুতদার ব্যবসায়ী হতে আল্লাহতায়ালা দায়মুক্ত হওয়ার ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুত করে রাখবে, সে আল্লাহতায়ালা থেকে এবং আল্লাহতায়ালা তার থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাবেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪৮৮০)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা