মহান রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তারই ইবাদতের জন্য, তার নির্দেশনাবলী মান্য করার জন্য। সুতরাং, মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনাবলীর পূর্ণ অনুগত থাকা। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মেনে চলা এবং নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকাই ইবাদত।
পবিত্র কোরআনে একাধিক জায়গায় আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে হালাল গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। যেমনÑ সুরা বাকারার ১৬৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে, তা থেকে তোমরা আহার করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’। (সুরা বাকারা : ১৬৮)।
এ আয়াতে শুধু মুসলিম নয়, মানবজাতিকে হালাল গ্রহণের আদেশ করা হয়েছে। এছাড়া সুরা বাকারার ১৭২ নম্বর আয়াতে বিশেষভাবে সব মোমিনের প্রতি হালাল গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ, আমি তোমাদের জীবিকারূপে যে উৎকৃষ্ট বস্তুগুলো দিয়েছি, তা থেকে (যা ইচ্ছা) খাও এবং আল্লাহর শুকর আদায় করোÑ যদি সত্যিই তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করে থাকো। (সুরা বাকারা : ১৭২)।
এ আয়াতে হালাল গ্রহণের পাশাপাশি এর জন্য শুকরিয়া আদায় করতেও বলা হয়েছে। এছাড়া আয়াতটির শেষাংশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাতে বলা হয়েছে, সত্যিকার অর্থে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করার দাবি করলে তা প্রমাণ করার পথ হলো, বাস্তব জীবনে হালাল গ্রহণ করা। সুতরাং, আমরা প্রতিনিয়ত নামাজে সুরা ফাতেহায় যা বলছিÑ ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি’ সেটি প্রমাণ করতে হলে আমাদের হালাল গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা সেটি শুধু একটি মুখের দাবি হবে।
কোরআনুল কারিমের পাশাপাশি হাদিসেও হালাল গ্রহণের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হালাল রুজি অন্বেষণকে ওয়াজিব শব্দে ব্যক্ত করেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘হালাল রুজি সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর অনিবার্য।’ [মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস ১৮০৯৯ অবশ্য উপার্জনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। কখনও তা ফরজ হয়, কখনও মুস্তাহাব, যা ফিকহ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু ইতিবাচক পদ্ধতিতে হালাল গ্রহণের প্রতি গুরুত্বরোপ করেই ক্ষ্যান্ত করেননি; পাশাপাশি হালাল গ্রহণ না করার পরিণতি উল্লেখ করেও সতর্ক করেছেন।
খলিফায়ে রাশেদ আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সেই দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যাকে তৃপ্ত করা হয়েছে হারাম দ্বারা।’ মুসনাদে আবু ইয়ালা, ৭৮, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খ. ১০, পৃ. ৩৮০।
পাশাপাশি হালাল গ্রহণকে দোয়া কবুলের পূর্ব শর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। হারাম ভক্ষণ করলে দোয়া এবং ইবাদত কিছুই কবুল হবে না। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেনÑ ‘হে লোক সব! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্রতা ছাড়া কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তায়ালা রাসূলদের যে বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন, মোমিনদেরও সে বিষয়ে আদেশ করছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেনÑ ‘হে রাসুল! পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকর্ম করো। নিশ্চয় আমি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত।’ (সুরা মুমিনুন : ৫১)।
অন্যত্র বলেছেন, ‘হে ইমানদাররা! আমি তোমাদের যে উত্তম রিজিক দিয়েছি, তা থেকে আহার করো।’ (সুরা বাকার ১৭২)। এরপর নবীজি এমন এক ব্যক্তির কথা আলোচনা করলেন, যে মরুভূমিতে দীর্ঘ সফর করেছেন, যার চুলগুলো এলোমেলো, ধুলায় ধুসরিত। এ অবস্থায় তিনি আকাশের দিকে দুই হাত তুলে দোয়া করে বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক!’ অথচ তার খাদ্য হারাম। পানীয় হারাম। পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম। তার শরীর বেড়ে উঠেছে হারাম দ্বারা। অতএব, তার দোয়া কীভাবে কবুল করা হবে!?’ মুসলি, হাদিস ১০১৫।
দেখুন; সফরে থাকা, অক্ষমতা, মুখাপেক্ষিতা ইত্যাদি দোয়া কবুলের সহায়ক বিভিন্ন উপাদান থাকা সত্ত্বেও শুধু হালাল গ্রহণ না করার কারণে দোয়া কবুল করা হয়নিÑ এটি ভাবার বিষয়। শুধু নেক কাজ করাই যথেষ্ট নয়; হারাম থেকে বেঁচে থাকাও জরুরি। ‘তার দোয়া কীভাবে কবুল করা হবে’ হাদিসে এ অংশটি বেশ ভাবার বিষয়। ‘দোয়া কবুল হবে না’ বলা হয়নি। নবীজি কতটা আশ্চর্য প্রকাশ করলেন! কত দৃঢ়তার সঙ্গে বিষয়টি তুলে ধরলেন!
আরেক হাদিসে এরশাদ হয়েছেÑ আবু বারযাহ আসলামী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেÑ ‘কেয়ামতের দিন কারও দুই পা সামনে অগ্রসর হবে না, যাবৎ তাকে তার জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, কীভাবে সেটা ব্যবহার করেছে। তার ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, সে অনুযায়ী আমল করেছে কি না। তার সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে, কোথায় তা ব্যয় করেছে। তার দেহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, কীভাবে তা ক্ষয় হয়েছে’। (জামে তিরমিজি : ২৪১৭)।
লক্ষ্যণীয়, উক্ত হাদিসে মোট পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে দুটি প্রশ্নই অর্থনীতি সংক্রান্ত। অ্যাকাউন্টের দৃষ্টিতে ৪০ শতাংশ প্রশ্ন হবে অর্থনীতি বিষয়ে। প্রায় অর্ধেক। বিষয়টি বেশ ভাবার। আমরা আমাদের জীবনে অর্থনীতি হালাল হওয়া ও হারাম মুক্ত থাকার বিষয়টি কত পার্সেন্ট চিন্তা করি!
মোট কথা, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মেনে চলাই ইবাদত। সুতরাং, আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করে হারাম ভক্ষণ করার অর্থ হলোÑ হালাল গ্রহণ সংক্রান্ত ইবাদত লঙ্ঘন করা। পাশাপাশি অন্য ইবাদত কবুল হওয়ার জন্যও হালাল গ্রহণ শর্ত। সুতরাং, কেউ যদি হারামে লিপ্ত হয়, তাহলে সে একটি ইবাদত তো সরাসরি অমান্য করল। পাশাপাশি অন্য যে সব ইবাদত করেছিল সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ফলে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়ে গেল। তাই মানুষের জীবনে হালাল গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
এছাড়া পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাস করতে হলেও শরিয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়গুলো ত্যাগ করতে হবে। উপার্জনের ক্ষেত্রে শরিয়ত যেসব বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলো পরিহার করা ছাড়া সুন্দর সমাজ এবং নিরাপদ জীবন সম্ভব নয়। কেন না, শরিয়ত যেসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, সেগুলো ইবাদতের পাশাপাশি মানবজীবনেও অনেক বেশি ক্ষতিকর। এসবের ফলে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়ে যায়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য থাকে না। স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হয়।
যেমনÑ শরিয়ত সুদ-জুয়া নিষিদ্ধ করেছে। সুদ গ্রহণকে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কেয়ামতের দিন সুদখোরকে বলা হবেÑ তুমি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। (তফসিরে ইবনে কাসির, ১ : ৪০৮; দারুল হাদিস কায়রো)।
তেমনি জুয়ার ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কোরআনে জুয়াকে ‘মাইসির’ এবং হাদিসে ‘ক্বিমার’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা যদি সমাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, আমাদের সামাজিক জীবনে এ দুটির ক্ষতিকর দিক অনেক ভয়াবহ।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতিনৈতিকতা সবকিছুর জন্য হুমকি হলো সুদ এবং জুয়া। এজন্য বেশিরভাগ রাষ্ট্রেই জুয়া নিষিদ্ধ। যদিও রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ জুয়ার বাইরেও সমাজে প্রচলিত আরও নানা ধরনের জুয়া আছে।
বর্তমানে আমাদের গোচরে-অগোচরে সমাজে জালের মতো ছড়িয়ে পড়ছে জুয়ার ব্যাধি। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রামেগঞ্জে ছোট্ট হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং চা-স্টলগুলোয়ও দেদারসে জুয়াবাজি চলে। বিনা কষ্টে বা স্বল্প কষ্টে অনেক বেশি পরিমাণ টাকার মালিক বনে যাওয়ার দিবা স্বপ্নে অনেক শিশু-কিশোরও জড়িয়ে যাচ্ছে এই ভয়াবহ চক্রে। এতে শুধু তারা অর্থনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না; নষ্ট হচ্ছে তাদের নীতি-নৈতিকতা। জুয়ার টাকা খোয়ানোর ভয়ে মানুষ নানা ধরনের অসদুপায় অবলম্বন করতেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। লিপ্ত হচ্ছে হত্যা, অপহরণ এবং ধর্ষণের মতো জঘন্য কর্মকা-ে।
অন্যদিকে সুদ যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু এর সামাজিক ক্ষতির দিকও অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে কিছু মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও অধিকাংশ ক্রমশই দারিদ্র্যের নিম্ন থেকে নিম্ন সীমায় নেমে যাচ্ছে। সম্পদ একীভূত হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষের হাতে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। ক্ষুদ ্রঋণের চক্রে জড়িয়ে কত মানুষ যে বাড়ি-বাস্তু হারা হচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে?
এছাড়া শরিয়ত লেনদেনের ক্ষেত্রে ধোঁকা, প্রতারণা এবং লোক ঠকানো কারবার থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। লেনদেনে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যের মালিকানাধীন বস্তু বিক্রি বাতিল সাব্যস্ত করেছে। আর এগুলোর সামাজিক ক্ষতি তো সবার কাছেই স্পষ্ট। এর বাইরে শরিয়ত আরও কিছু বেচাকেনার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছে। যেমনÑ মজুতদারি, তালাক্কিয়ে জলব ইত্যাদি। কেন না, এসবের কারণে বাজারের স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শরিয়ত নিষিদ্ধ লেনদেনের সামাজিক ক্ষতিগুলো আমাদের সামনে একেবারেই স্পষ্ট। একটু চোখ মেলে আমাদের আশপাশে নজর দিলেই আমরা এর অনেক উদাহরণ দেখতে পাব।
পক্ষান্তরে শরিয়ত নির্দেশিত পথে যদি লেনদেন করা হয়, তাহলে আল্লাহর নির্দেশ মান্য করার পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রায়ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। মানবজীবন গতিশীল হবে। দুশ্চিন্তামুক্ত শান্তির জীবন লাভ করবে। সুতরাং, মানুষের জীবন সুচারুভাবে পরিচালনা করার জন্য হালাল গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। হালালেই রয়েছে জীবনযাত্রার ভারসাম্য, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নৈতিক উৎকর্ষ। একটি সুন্দর গতিশীল উন্নত এবং সুখময় সমাজ গঠনে তাই ইসলামের হালালনীতি অনুসরণ করা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদের হালালময় জীবন দান করুন।