ঢাকা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঋণ প্রদান ও পরিশোধে ইসলামের নির্দেশনা

মুফতি আতিকুল্লাহ বিন আসাদ
ঋণ প্রদান ও পরিশোধে ইসলামের নির্দেশনা

ঋণ প্রদান একটি নেকির কাজ। ইসলামে ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের অভাব মোচন কিংবা নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনে পরোপকার করা। ঋণ আদান-প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন অটুট ও মজবুত হয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজিদে মানুষকে উত্তম ঋণ প্রদানের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। উত্তম ঋণের বহুগুণ বিনিময় ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কে সেই ব্যক্তি? যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে, ফলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আর আল্লাহই রিজিক সংকুচিত করেন এবং বৃদ্ধি করেন আর তোমাদের তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা বাকারা : ২৪৫)। বর্ণিত আয়াতে আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তার বান্দাদের ঋণ দিয়ে তাদের অভাব মোচন করা। কেউ যদি মানুষের প্রতি করুণা করে তাহলে আল্লাহও তার প্রতি করুণা করবেন।

ইসলামে ঋণ প্রদানের প্রতি যেমন উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে ঋণগ্রহীতাদেরও যথাযথভাবে তা পরিশোধের ব্যাপারে সচেতন করা হয়েছে। ঋণগ্রহীতার কর্তব্য হচ্ছে, যথাসময়ে উত্তম উপায়ে ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম (সা.) এর জিম্মায় একজন লোকের এক নির্দিষ্ট বয়সের উট ঋণ ছিল। লোকটি তার কাছে সেটির তাগাদা করতে আসল। তিনি সাহাবিদের বললেন, তাকে একটি উট দিয়ে দাও। তারা সে বয়সের উট তালাশ করলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি বয়সের উট ছাড়া পাওয়া গেল না। তিনি বললেন, সেটি তাকে দিয়ে দাও। লোকটি বলল, আপনি আমাকে পূর্ণ হক দিয়েছেন, আল্লাহ আপনার পূর্ণ বদলা দিন। নবী করিম (সা.) বললেন, তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক সেই, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে।’ (বোখারি : ২৩৯৩)। অবশ্য প্রদত্ত ঋণের চেয়ে উত্তম কিছু পাওয়ার আশা করা ঋণদাতার পক্ষে মোটেই সঙ্গত নয়।

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি অনেক সময় একত্রে ঋণ পরিশোধে জটিলতার শিকার হন। সেক্ষেত্রে তাকে সহজ ব্যবস্থা করে দেওয়া অথবা পূর্ণ বা আংশিক ক্ষমা করে দেওয়ার অনেক ফজিলত রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আগের যুগে এক ব্যক্তি মানুষকে ঋণ দিত। সে তার কর্মচারীকে বলত, কোনো ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধে অক্ষম দেখলে তাকে ক্ষমা করে দিও। এ কারণে হয়তো আল্লাহ তায়ালা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। এরপর ওই লোকটি আল্লাহর দরবারে পৌঁছলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ (বোখারি : ৩৪৮০)। পাওনা পরিশোধকালে পাওনাদারের কৃতজ্ঞতা জানানো এবং তার জন্য কল্যাণের দোয়া করা ইসলামের এক অনন্য শিক্ষা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি রবিয়া (রা.) থেকে ৪ হাজার দিরহাম ঋণ করেছিলেন। যখন তা পরিশোধ করলেন, তখন তিনি তার জন্য এ দোয়া করলেনÑ ‘আল্লাহ তায়ালা তোমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদে বরকত দান করুন।’ (নাসায়ি : ৪৬৮৩)।

অনেক লোক আছেন যারা ঋণগ্রহণ করে পরিশোধের ক্ষেত্রে নানা টালবাহানার আশ্রয় নেন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। এটা খুবই নিন্দনীয়। এ ধরনের কাজ যারা করেন তারা মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। কোনো ব্যক্তি যদি মানুষের কাছে আস্থাভাজন থাকতে চান এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে উপকার পেতে চান, তাহলে তার কর্তব্য হচ্ছেÑ যে কোনো উপায়ে কথা রক্ষা করা এবং সময়মতো ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া। ঋণ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছেÑ লেনদেনের বিষয়টি লিখে রাখা। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের নির্দেশ হলো, ‘হে ঈমানদাররা! যখন তোমরা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের লেনদেন করো, তখন তা লিখে রাখো।’ (সুরা বাকারা : ২৮২)।

একান্ত অপারগতার ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতার কর্তব্য হচ্ছেÑ ঋণদাতাকে অনুরোধ জানিয়ে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ কিছুদিন বাড়িয়ে নেওয়া এবং বর্ধিত মেয়াদ অনুযায়ী অবশ্যই ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া। কিন্তু তা না করে পাওনাদারের দৃষ্টিপথ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা শোভনীয় নয়। ঋণ নিয়ে যথাসময়ে ফেরত না দেওয়া কোনো মুসলমানের চরিত্র হতে পারে না। কেন না, এ কারণে ঋণ দাতাকে দুশ্চিন্তা ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর ঋণ ফেরত না দেওয়ার চিন্তা করা বড় অপরাধ। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ নেওয়ার সময়ই ফেরত না দেওয়ার নিয়ত করে, সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে চোর হিসেবে দাঁড়াবে।’ (ইবনে মাজাহ : ২৪১০)। ঋণের দায়ে শুধু সাধারণ মোমিন নয় বরং আল্লাহর রাস্তায় শহিদরাও পার পাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হয়, তবে ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বোখারি : ৩৬০০)।

যদি সম্ভব হয়, তাহলে ঋণ না নেওয়াই উত্তম। নবী করিম (সা.) ঋণ হতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেনÑ আল্লাহুম্মা! ইন্নি আউযুবিকা মিনাল কাসালি, ওয়াল হারামি, ওয়াল মা’ছামি, ওয়াল মাগ্রাম। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় কামনা করছি অলসতা, অধিক বার্ধক্য, গোনাহ এবং ঋণ হতে।’ (মুসলিম : ৬৮৭১)।

লেখক : খতিব, রোশাদিয়া শাহী জামে মসজিদ, উত্তরা, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত