ঢাকা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সওয়াল জওয়াব

মুফতি আবদুল মালেক শিক্ষা সচিব, মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়া, ঢাকা
সওয়াল জওয়াব

প্রশ্ন : সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি জন্মসূত্রে এই এলাকার একজন স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের এই গ্রামে (দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ৯নং ভিয়াইল ইউনিয়নের জয়পুর গ্রাম) একটি ফাজিল মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসা মাঠের সঙ্গেই এলাকার কবরস্থান অবস্থিত। এ কবরস্থানের সঙ্গেই একটি মাজার ও তার কয়েক হাত সামনেই একটি বিশেষ পুকুর অবস্থিত।

মাদ্রাসা মাঠেই প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহে (নির্ধারিত) দিনব্যাপী ওয়াজ-মাহফিল ও ্ইসালে সাওয়াব হয়। উল্লিখিত, দুই দিন মাজার ও পুকুরের আসল কার্যক্রম চলে। আর সারা বছরই মানুষের আসা-যাওয়ার মাধ্যমে তা অব্যাহত থাকে।

মাজারের দানবক্সে মানুষ দান করে এবং পুকুরের পানি পান করে এবং বোতলে করে নিয়ে যায়। মানুষের ধারণা এ মাজারে দান করলে ও পুকুরের পানি পান করলে তাদের সমস্যা সমাধান, অসুস্থতা দূর হবে এবং সন্তান লাভ হবে ইত্যাদি। এখানে প্রচুর মুরগি, ছাগল, চাল ও টাকা মানুষ দান ও মান্নত করে। এ মাজার ও পুকুরে নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে, মুসলিম-অমুসলিম সবাই আসে। হিন্দুরা তাদের নিয়ম অনুযায়ী হাত নমস্কার করে, দান করে ও পানি নিয়ে যায়। আর মুসলমানরা হাত তুলে দোয়া করে ও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ইত্যাদি।

এ মাজারের উপর একটা বিশাল গাছ আছে ও তার পাশেই আরেকটা বিশাল গাছ আছে। এ গাছ দুটির ব্যাপারেও মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করে। বয়স্করা এ মাজার ও পুকুরের আশ্চর্য ঘটনাবলী বর্ণনা করেন। এখানে বর্তমানেও কোনো স্বাভাবিক কাজে বিঘœতা ঘটলে এ মাজারের কারামত বলে মনে করে ও ভয় করে। এখন আমার বিশেষ জানার বিষয় হলো ১. যে কোনো প্রয়োজনে মাজারে দান, দোয়া ও মান্নত করার হুকুম কী? ২. নিয়ত অনুযায়ী পুকুরের পানি পান করলে উপকার হয় বা সমস্যা দূর হয় এ রকম বিশ্বাসের হুকুম কী? এবং তা যদি কেউ আল্লাহর ওয়াস্তেই করে। (আমাদের এলাকার লোকজন বিশ্বাস করে আল্লাহর ওয়াস্তে করলে সমস্যা নেই) আমাদের এলাকার লোকজন ইসলামপ্রিয় ও আলেম-ওলামাদের ভালোবাসে। তবে এ বিষয়টি সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা আপনাদের দলিলভিত্তিক জবাব পেলে বিষয়টি এলাকার লোকজন ও কমিটি অবশ্যই মানবে। অতএব, এই কার্যক্রমের উপর বিবেচনা করে শরিয়তের দৃষ্টিতে এর হুকুম ও আমাদের করণীয় বলবেন কি। মুহাম্মাদ মুতাররিফ-চিরিরবন্দর, দিনাজপুর

উত্তর : ১. যে কোনো মাজারওয়ালা বা কবরবাসী, এমনকি ওলি-বুজুর্গ হয়ে থাকলেও তার কাছে কিছু চাওয়া শিরক। কেন না, দোয়া ও সাহায্য প্রার্থনা শুধু আল্লাহ তায়ালার কাছেই করা যায়। দোয়া একটি ইবাদত। আর সব ইবাদত আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। সুরা ফাতেহায় আছেÑ ‘আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই কাছে সাহায্য চাই।’ (সুরা ফাতেহা : ৪)।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছেÑ ‘আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন, তোমরা একমাত্র তারই ইবাদত করবে।’ (সুরা ইফসুফ : ৪০)।

সুরা রা’দে (আয়াত : ১৪) আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘সত্য প্রার্থনা সেটিই, যা আল্লাহ তায়ালার কাছে চাওয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য যে কারও কাছেই প্রার্থনা করা হোক, তা বৃথা এবং তা কাফেরদেরই কাজ।’ হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, দোয়া-ই ইবাদত। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এ আয়াত পাঠ করেন, তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, তোমরা আমার কাছে দোয়া করো, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত হতে বিমুখ হবে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (সুরা মু’মিন : ৬০; জামে তিরমিজি, হাদিস ২৯৬৯) মাজারে গিয়ে দোয়া করার ব্যাপারে হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.) বলেন, যারা আজমীর, সালার মাসউদ প্রমুখ বুজুর্গদের মাজারে গিয়ে স্বীয় উদ্দেশ্য লাভের জন্য প্রার্থনা করে, তারা হত্যা ও ব্যভিচারের চাইতে জঘন্য পাপ করে। তাদের উপমা হলো ওই মুশরিকদের ন্যায়, যারা স্বহস্তে বানানো মূর্তি পূজা করে এবং লাত উযযার পূজা করে। (তাফহিমাতে ইলাহিয়্যাহ ২/৪৯)।

অনুরূপভাবে মান্নতও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নামেই করা যায়। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারও নামে মান্নত করা হারাম ও শিরক। প্রসিদ্ধ ফিকহ গ্রন্থ আলবাহরুর রায়েকে আছেÑ ‘মাজার ও পীরদের নামে মান্নত করা সবার ঐকমত্যে বাতিল। এর একাধিক কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো, এ মান্নত মাখলুকের নামে হচ্ছে। আর কোনো মাখলুকের জন্য মান্নত করা জায়েজ নেই। কেন না, মান্নত করা একটি ইবাদত। আর ইবাদত কোনো মাখলুকের জন্য হতে পারে না।’ (আল বাহরুর রায়েক ২/২৯৮)।

আর মাজার ও কবর দান-সদকার জায়গা নয়। সেখানে দান-সদকার টাকা দিয়ে বহুবিধ শিরক এবং বিদ’আত কাজ সংঘঠিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মাজারে দান করার মানে এসব গোনাহে সহযোগিতা করা। আর দানের উদ্দেশ্য যদি মাজারওয়ালার নৈকট্য অর্জন বা কোনো উপকার লাভ করা হয়, তবে তো এভাবে দান করাটাই শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তাই মাজারে টাকা-পয়সা দেওয়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

২. কোনো পুকুরের ক্ষেত্রে প্রশ্নোক্ত বিশ্বাস রাখাও শিরকের শামিল। এটি সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভ্রান্ত ধারণা। মতলবি লোকরা এসব শিরকি কর্মকা- চালু করেছে। তাই এমন বিশ্বাস ও কর্ম থেকে বিরত থাকা ফরজ। এমনকি ওই বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে পানি পান করাও জায়েজ হবে না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা ওই পুকুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলে দেননি। কোরআন-হাদিসের কোথাও বিশেষ কোনো পুকুরের ব্যাপারে আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ নেই। এ ধরনের শিরকি কর্মকা-ের সঙ্গে আল্লাহর নাম ব্যবহার করা আরও মারাত্মক গোনাহ। তাই মুসলমানদের এসব কিছু থেকে বিরত থাকা ফরজ। (রুহুল মাআনী ১৭/২১২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৩৯; ইমদাদুল আহকাম ১/১২৮)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত