ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দুটি মূলনীতি রয়েছে। এক. মূলগত : যা উপার্জন করা হবে তা মূলগতভাবে হালাল হতে হবে। দুই. পদ্ধতিগত : যা উপার্জন করব তা বৈধ পন্থায় হতে হবে।
এক. মূলগত : একজন ব্যক্তি যা উপার্জন করবে সে উপার্জিত বস্তুটি অবশ্যই উত্তম ও হালাল হতে হবে। আর ইসলাম যাবতীয় কল্যাণকর ও হিতকর বস্তুকে মানবজাতির জন্য হালাল করেছে। সে লক্ষ্যেই পবিত্র কোরআনে হালাল ও তাইয়্যেবাত শব্দের অবতারণা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সম্বোধন করে হালাল ও তাইয়্যিব যা রয়েছে তা থেকে আহার করতে বলেছেন। তিনি বলেন : ‘হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যেব যা রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারাহ : ১৬৮)।
উপরোক্ত আয়াতের আলোকে বলা যায়, শুধু হালাল হলেই চলবে না; বরং তা অবশ্যই তাইয়্যিব (পবিত্র ও উত্তম) হতে হবে। এখানে তাইয়্যিব বলতে ভেজালমুক্ত স্বাস্থসম্মত উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন উপায় অবলম্বন করতে হবে যা মূলগতভাবেই নির্ভেজাল, খাঁটি ও পবিত্র। অবশ্য অধিকাংশ মুফাসির আয়াতে হালাল শব্দ দ্বারা মূলগত বৈধতার এবং তাইয়্যিব দ্বারা পদ্ধতিগত বৈধতার অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং এ দু’শব্দ দিয়ে দুটি মূলনীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
দুই. পদ্ধতিগত : উপার্জনের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় উপায় ও মাধ্যমটি অবশ্যই বৈধ পন্থায় হতে হবে। কেননা, যাবতীয় অবৈধ উপায় ও পন্থায় অর্থসম্পদ উপার্জন করতে ইসলাম নিষেধ রয়েছে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে এ বিষয়ে মোমিনদের সতর্ক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন : ‘হে মোমিনরা! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ এবং একে অপরকে হত্যা করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর যে কেউ সীমালংঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তাকে আমি অগ্নিতে দগ্ধ করব, আর এটা করা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সুরা নিসা : ২৯)। মহান আল্লাহ বলেন : তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে পেশ করো না। (সুরা বাকারাহ : ১৮৮)।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, উপার্জনের পদ্ধতি ও পন্থা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। অন্যথায় কঠোর শাস্তির ঘোষণা রয়েছে। আর এ ধরনের উপায় জুলমের নামান্তর। যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। অতএব, প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত উচিত উপার্জনের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত দুটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা।
প্রখ্যাত আধুনিক তফসিরকার আল্লামা রশিদ রেজা আয়াতে উল্লেখিত হালাল ও তাইয়্যিবা এ দুটি শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, কোনো বস্তু তাইয়্যিব বা উত্তম হওয়ার অর্থ হলো তাতে অন্যের অধিকার সম্পৃক্ত না থাকা। কেননা, পবিত্র কোরআনে যেসব বস্তুর ব্যাপারে হারাম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো মূলগতভাবেই হারাম বা নিষিদ্ধ। একমাত্র নিরূপায় অবস্থা ছাড়া কোনো অবস্থাতেই তার ব্যবহার বৈধ নয়। এছাড়াও এক ধরনের হারাম রয়েছে যা মূলগতভাবে হারাম নয় কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো কারণে তাকে হারাম বলা হয়েছে। মূলত এ জাতীয় বস্তুর বিপরীতেই তাইয়্যিব বা উত্তম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং যেসব বস্তু অন্যায়ভাবে উপার্জন করা হয়েছে, ন্যায়ানুগ পন্থায় করা হয়নি। যেমনÑ সুদ, ঘুষ, জুয়া, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধোঁকা-প্রতারণা, আমানতের খিয়নত ইত্যাদি পন্থায় করা হয়েছে এগুলো হারাম। অর্থাৎ এগুলো তাইয়্যিব বা উত্তম নয়। সারকথা প্রতিটি অপবিত্র বস্তুই হারাম, তা মূলগত কারণেই হোক কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কারণেই হোক।
হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের গুরুত্ব ইসলামে যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও অত্যাধিক। ইসলাম মানুষের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণকে সহজসাধ্য, সুস্পষ্ট, ও পবিত্র করার নিমিত্তে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা দিয়েছে। অতএব, নির্দেশনাবহির্ভূত যাবতীয় উপার্জনই হারাম বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত। ইসলামের বক্তব্য হলো মানুষকে নিজের সামর্থ্য ও যোগ্যতানুযায়ী নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ ও দ্রব্য সামগ্রীর সন্ধান করবে। এটি মানুষের অন্যতম অধিকার। তবে ইসলাম মানুষকে এ অধিকার দেয়নি যে, সে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের জন্য স্বীয় খেয়ালখুশিমতো যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারবে। তাই তো ইসলাম অর্থসম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর যাবতীয় ব্যবস্থাকে ইসলাম হালাল করেছে। নিম্নে এ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
এক. হালাল উপার্জন একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান : ইসলাম মানুষের জন্য হালাল ও হারামের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপণ করেই শেষ করেনি, বরং হালাল উপার্জনে রয়েছে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফরজ ইবাদতগুলো আদায়ের পর এ মহতি কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও বৈধ উপায় অবলম্বন করা ব্যবসায়ীসহ সব মানুষের ওপর ইসলামের একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। যারা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না তাদের ব্যাপারে নবী করিম সতর্কবাণী করেছেন। তিনি বলেন : ‘মানুষের কাছে এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোনো উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করবে না।’ (বোখারি : ২০৫৯)।
দুই. হালাল উপার্জন দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত : মানুষের প্রাত্যহিক ও জাগতিক জীবনের চাহিদার কোনো অন্ত নেই। তবে এগুলো মানুষের কাক্সিক্ষত ও বঞ্চিত হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মহান স্রষ্টার অনুগ্রহের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আর এর জন্য প্রয়োজন একান্তে তার দরবারে আরাধনা করা। মহান আল্লাহ ও মানুষে এ ব্যাপারে সাড়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এটি অন্যতম ইবাদতও বটে। রাসুল (সা.) বলেন : ‘দোয়া হচ্ছে ইবাদত।’ (আবু দাউদ : ১৪৭৯)। অতএব, দোয়া ইসলামে অন্যতম একটি ইবাদতে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর গভীর প্রেম নিবেদন করা চলে এবং যাবতীয় প্রয়োজন পূরণে সহায়ক হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি আল্লাহর দরবারে গৃহীত হতে হলে উপার্জন অবশ্যই হালাল হতে হবে। কেননা, আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোনো কিছুই গ্রহণ করেন না, অতএব, অবৈধ উপার্জন যারা করে তাদের খাদ্যের উপার্জন হয়, অবৈধ অর্থে হওয়ায় ইসলম যাবতীয় রক্ত গোশত সবই হারাম দ্বারা পুষ্ট হয়। ফলে এ ধরনের ব্যক্তির প্রার্থনাকে ইসলামে কখনও সমর্থন করে না। এ মর্মে রাসুল (সা.) বলেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়াল পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মোমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসুলদের।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদের রুজি হিসেবে দান করেছি।’ অতঃপর রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে, ‘হে আমার প্রভু! হে আমার প্রভু! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম : ১০১৫)।
ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) এর কাছে একদা এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হলো। হে মানবম-লী! পৃথিরীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ কর।’ তখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেন : হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসুল (সা.) বললেন : হে সা’দ, তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবে তোমার দোয়া কবুল হবে।’ (ইমাম তাবারানি, মু’জামুল আওসাত, খ. ৬, পৃ. ৩১০)।
তিন. হালাল উপার্জনে বরকত লাভ হয় : উপার্জনে বরকত লাভ করতে হলে একমাত্র হালাল পন্থায় হতে হবে। কেননা, বরকত দানের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি শুধু বৈধ উপার্জনকেই বরকত ম-িত করেন এবং যাবতীয় অবৈধ উপার্জনের বরকত নষ্ট করে দেন। আর যেখানে অপচয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সম্পদের প্রাচুর্যতা লাভে বিলম্ব হয়। অন্যদিকে হালাল উপার্জন কম হলেও তাতে বরকতের কারণে খুব স্বল্প সময়েই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চার. হালাল উপার্জন জান্নাত লাভের একমাত্র উপায় : মানুষের দুটি জীবন রয়েছে, একটি ইহলৌকিক, অপরটি পরলৌকিক। অতএব, হালাল পন্থায় উপার্জনকারী পরকালে জান্নাতে যাবে। আর অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে তার জন্য ভয়াবহ আজাব ও শাস্তি অপেক্ষা করছে।
পাঁচ. অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনকারীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত : ইবন আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন : ‘আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোজখের আগুনই উত্তম।’ (ইমাম তাবারানি, মু’জামুল আওসাত, খ. ৬, পৃ. ৩১০)। কাব ইবন উজরাহ (রা.) রাসুলে কারিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন : ‘যে শরীর হারাম পেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে যাবে না।’ (আবু ইয়া’লা, মুসনাদ আবি ইয়ালা, খ.১ পৃ. ৮৪)।
দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য পুরস্কার ও শাস্তি উভয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যারা তার অনুগত বান্দা তারাই পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে। যেহেতু অবৈধ উপায়ে উপার্জনকারী ব্যক্তি তার অবাধ্য ও দুশমন তাই তাদের জন্যও শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অতএব, এ পন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তি জাহান্নামী।
ছয়. হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের শর্ত : অর্থ-সম্পদ দ্বারাই মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তার দেহের বৃদ্ধি ঘটে এবং সুস্বাস্থ্য লাভ হয়। কিন্তু এ উপকরণ ক্রয়ের অর্থ যদি অবৈধ উপায়ে উপার্জিত হয় তবে তা কীভাবে বৈধ শারীরিক বৃদ্ধি হতে পারে। ফলে তার শরীরের রক্তে ও গোশতে অবৈধ বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটে। আর এর দ্বারা যত ইবাদতই করা হোক না, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা, আল্লাহ অপবিত্র কোনো কিছুই গ্রহণ করে না। অতএব, হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত হিসেবে শিরোধার্য। সালাত, জাকাত ও হজ ইত্যাদি ফরজ ইবাদতগুলো কবুল হওয়ার জন্য অবশ্যই বৈধ পন্থায় উপার্জন করতে হবে।
আলোকিত ডেস্ক