ঢাকা ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ওয়াজ মাহফিল ইসলাম প্রচারের চমৎকার এক মাধ্যম

ওয়াজ মাহফিল ইসলাম প্রচারের চমৎকার এক মাধ্যম

ওয়াজ মাহফিল এ দেশের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশ। আবহমান কাল ধরে বাঙালি মুসলিম সমাজে এটি প্রচলিত। আর কোরআন কারিমের ৭৭টি নামের এক নাম হলো ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। মহান আল্লাহ হলেন, প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন দ্বিতীয় ওয়ায়েজ, এই সূত্রে নবী করিম (সা.)-এর উত্তরাধিকারীরা ওয়ায়েজিন। এ উম্মতের দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করবেন ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া তথা নবীদের উত্তরাধিকারী ওলামায়ে কেরাম। আর ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হলো এ দাওয়াতি কাজ কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তফসির ইত্যাদি দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল : ১২৫)।

‘ওয়াজ’ হলোÑ সুন্দর, আকর্ষণীয়, যুক্তিপূর্ণ ও হৃদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। আর দেশ-বিদেশের সমকালীন খ্যাতিসম্পন্ন ওলামায়ে কেরাম তাতে উপস্থিত থেকে কোরআন-হাদিসের আলোকে সারগর্ভ নসিহত পেশ করতেন। মুসলমানদের ইমান-আক্বিদা ও আমলী সংশোধন, আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং যুগসচেতন হওয়ার আহ্বান করা। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত মাহফিলের ইতিবাচক ফায়েদা; কিন্তু একেবারে কম নয়। মদ-জুয়া, যাত্রা, নর্তকী ও গানের কনসার্টের বিপরীতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন সত্যিই খুব প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মাহফিলগুলো যাতে করে রেওয়াজ ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয়, সেদিকে অবশ্য খেয়াল রাখতে হবে। বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। ইলম ও আমলওয়ালা ওলামা এবং বুজুর্গানে কেরামরাকে মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালেও একজন মানুষেরও হেদায়াত হবে না।

একথা স্বীকার করতে বাধ্য, আমাদের বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো সেই প্রভাবময় নয়। আগে বক্তাদের যে রকম ইলম ছিল, ছিল সে রকম আমলও। আর আজ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখনকার ওয়াজ মাহফিলগুলোতে বিশেষ অপচয়। শ্রোতাদের নিবেদন রক্ষার্থে বেশিরভাগ মাহফিলগুলোতে কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের আমন্ত্রণ ইত্যাদি ওয়াজ-মাহফিলের ধর্মীয় আবহ অনেকটা নষ্ট করে দিচ্ছে। আসলে এটা সমাজেরই দোষ। সমাজ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি মানুষের ভেতরের খুলুছিয়ত ও লিল্লাহিতের ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে। মূলত ওয়াজের উদ্দেশ্য কি, ওয়াজ কি ও কেন এটা অনেকেরই অজানা। তাই এই পরিবর্তন। হাদিসের আলোকে বলা যায় যে, ওয়াজের উদ্দেশ্য হবে মানুষকে ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা।

এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুধুই ওই আমল কবুল করেন, যা তার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। (বাইহাকি শরিফ)। হজরত আব হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শিখে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদতগুলোকে কবুল করবেন না’। (মিশকাত : ৪১০)। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তার লিখিত গ্রন্থ ‘আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া থেকে আখেরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তারা শ্রোতাদের পরকালীনমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস করা। ইবাদত-বন্দেগি ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা। সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করা। এটাই হলো প্রকৃত ওয়াজ। আর যে বক্তা এরূপ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে, তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বীনদার মুসলমানরা যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে। (মাজালিসুল আবরার : ৪৮২)। বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্যক : সেগুলো হলো : ১. ইলম, কেননা, ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম, ২. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য, ৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা, ৪. বক্তা শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে কথা বলা, ৫. বক্তা ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়া। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি ৪/১১০)।

আল্লাহর সন্তুষ্টি, দ্বীনের দাওয়াত ও মানুষের হেদায়াতকে লক্ষ্য না বানিয়ে যতই ওয়াজ হোক, তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না এবং এর দ্বারা মানুষের কোনো উপকারও সাধিত হয় না। অর্থকড়ি, যশ-খ্যাতি ও দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য যারা ওয়াজ করে বা ওয়াজের আয়োজন করে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ওয়াজকারী ব্যক্তির জন্য দুটি গুণ থাকা অপরিহার্য। যদি দুই গুণ না থাকে, তাহলে মানুষের হেদায়াত হবে না। কোরআনুল কারিমে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘তোমরা তাদের অনুসরণ কর, যারা দ্বীনি বিষয়ে কোনো পারিশ্রমিক চায় না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত’। (সুরা ইয়াসিন : ২১)। পরিশেষে, ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, ওয়াজ মাহফিলে কোরআন-হাদিসভিত্তিক আলোচনার জন্য বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আলেম নির্বাচন করবেন। তাহলে জাতি আরও বেশি উপকৃত হবে এবং ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। বস্তুত, এমন ওয়াজের মাধ্যমে পরকালে নাজাতের আশা করা যায়।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য, প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত