দুনিয়ার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে আল্লাহ মানুষকে সম্পদের মালিকানা দিয়ে থাকেন। সাময়িকভাবে মানুষ এ সম্পদের মালিক হয়। সম্পদের মালিক হওয়ার পদ্ধতি তো অনেক। কিন্তু যে পদ্ধতিতেই মানুষ সম্পদের মালিক হোক না কেন, এ সম্পদ তার চিরস্থায়ী কোনো সঙ্গী নয়। জীবনই যেখানে চিরস্থায়ী নয়, সেখানে জীবনের একটি অনুষঙ্গ সম্পদের মালিকানার স্থায়িত্ব কোথায়! ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে মালিকানাধীন ক্ষণস্থায়ী এ সম্পদের ব্যয় কীভাবে করতে হবে, ইসলাম সে নির্দেশনাও আমাদের দিয়েছে।
সম্পদ ব্যয় করার যেসব মূলনীতি ইসলাম আমাদের নির্দেশ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম অপচয় না করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সম্পদ দিয়ে থাকেন। এ সম্পদ ভোগ করার জন্যই। নিজের জন্য, নিজের স্ত্রী-সন্তানের জন্য, বাবা-মার জন্য, আত্মীয়স্বজনের জন্য আমরা এ সম্পদ ব্যয় করে থাকি। নিজের উপার্জিত টাকা কখনও আমরা বিলিয়ে দেই অসহায় গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়িয়ে। কখনও এ টাকা দিয়ে জনকল্যাণমূলক কোনো কাজেও আমরা শরিক হই। কথা হলো, আমরা যা কিছুই করি না কেন, উপরোক্ত মূলনীতিটিকে সামনে রাখতে হবে সর্বক্ষেত্রেই। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত লক্ষ্য করা যায়, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি মাচায় চড়ানো ও মাচাহীন উদ্যান, খেজুর গাছ ও বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য, জয়তুন এবং আনার সৃষ্টি করেছেন। এগুলো একটি আরেকটির সদৃশ এবং বৈসাদৃশ্যও। যখন তা ফল দেয়, তখন এর ফল থেকে তোমরা খাও এবং যেদিন তা কাটা হয়, সেদিন তার হক আদায় করো আর অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আনআম : ৪১)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার প্রাপ্য অধিকার দিয়ে দাও, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও তাদের অধিকার দিয়ে দাও, তবে অপব্যয় করো না। অপব্যয়কারীরা তো শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)।
কোরআন তো আমাদের দান-সদকা করার ক্ষেত্রেও মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়। কোরআনের ভাষ্য ‘তুমি তোমার হাত তোমার ঘাড়ে আবদ্ধ করে রেখ না, আবার তা সম্পূর্ণরূপে প্রসারিতও করে দিও না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৯)। অর্থাৎ দান করতে গেলেও সীমারেখা মনে রাখতে হবে। কার্পণ্যের শিকার হয়ে নিজের সব সম্পদ নিজের কাছে যেমন জমিয়ে রাখা নিন্দনীয়, ঠিক কেউ যদি এমনভাবে দান করে, যার অনিবার্য ফল হিসেবে একটু পরে আবার তাকেই হাত পাততে হবে অন্যের দুয়ারে, তাহলে তা-ও নিন্দনীয়।
কথা হলো, দান করার ক্ষেত্রেই যখন এ নির্দেশনা, তাহলে স্বাভাবিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে কী বিধান হবে? তা তো সহজেই অনুমেয়। এ ক্ষেত্রে আরও মনে রাখতে হবে, মিতব্যয়িতা বলতে ইসলাম কখনোই কার্পণ্যকে বোঝায় না। বরং অপচয় ইসলামে যেভাবে নিন্দিত, কার্পণ্যও ঠিক তেমনই ঘৃণিত। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বরং এমন বলেছেন, ‘সন্দেহ নেই, আল্লাহ তার বান্দাকে যে নেয়ামত দেন, তিনি সে বান্দার গায়ে সে নেয়ামতের চিহ্ন দেখতে পছন্দ করেন।’ (তিরমিজি : ২৮১৯)। এই হাদিস হচ্ছে ইসলামে মিতব্যয়িতার সংজ্ঞা। তোমার যতটুকু সম্পদ আছে, সবই তো আল্লাহর দান, আল্লাহর নেয়ামত। এ নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় দিয়েছেন ভোগ করার জন্যই। তা তুমি তোমার প্রয়োজনে ব্যয় কর। নিজের প্রয়োজনের টাকা খরচ করার সময় তোমার সামর্থ্যরে প্রতিও লক্ষ্য রেখ। কৃপণতা কর না। নিজেকে, নিজের ছেলে সন্তানদের, পরিবার-পরিজনকে অনর্থক কষ্টের মুখে ফেলে দিও না। যতটুকু সামর্থ্য আছে, ততটুকু খরচ কর। তবে অবশ্যই খেয়াল রেখ, নিজের কষ্টার্জিত টাকা-পয়সা যেন কিছুতেই অনর্থক কাজে ব্যয় না হয়। কিছুতেই যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজে ব্যয় না হয়। যতটুকু খাবে খাও, দামি কাপড় পরতে চাও পরো। কিন্তু অপচয় করো না। খাবার নষ্ট করো না। কাপড়চোপড় নষ্ট করো না। আর অবশ্যই গরিবের হকটুকু আদায় করে দাও।
ইসলাম এভাবেই আমাদের মধ্যমপন্থা শেখায়। অপচয় ও কার্পণ্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে এভাবেই আমাদের মিতব্যয়ী হতে শেখায়। আমাদের মুসলিম সমাজে যদি এই একটি মূলনীতি যথাযথ অনুসরণ করা হতো, তাহলে সমাজের চিত্র আরও অনেক সুন্দর হয়ে উঠত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই যে আমরা অপচয়ের সাগরে ডুবে আছি, বিবেকবান কারো কাছেই তা অস্পষ্ট নয়। অপচয় না করে এ টাকাগুলো যদি কল্যাণকর কোনো কাজে ব্যয় করা হতো, মানুষের উপকারে আসে এমন কোনো খাতে ব্যয় করা হতো, কিছুই না হোক, কমপক্ষে যদি সে টাকাগুলো ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও জমা থাকত, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা থাকত তবুও ভালো হতো। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনে তা খরচ করা যেত। আর আমরা বেঁচে যেতাম অপচয়ের অভিশাপ থেকে।
মিতব্যয়িতার এ সৌন্দর্য ইসলামের শিক্ষা, ইসলামের নির্দেশনা। প্রকৃত মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকতে চাইলে, সুন্দর সমাজ জাতিকে উপহার দিতে চাইলে এ শিক্ষা অনুসরণের বিকল্প নেই।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পানাহার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, কিশোরগঞ্জ