প্রযুক্তির আসক্তি নয়, সময়ের সঠিক ব্যবহার জরুরি
নন্দিত টিভি উপস্থাপক ও প্রখ্যাত আলোচক মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী। ধর্মীয় নানা ইস্যুতে জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখেন নিয়মিত। রচনা করেছেন ১২টি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি নামক সংগঠন। এ ছাড়া যুবক ও তরুণদের জন্য মাঠে-ময়দানে নানাভাবে সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির আসক্তিতে দিনরাত মত্ত। তাদের এ আসক্তির কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে বরেণ্য এ আলেমে দ্বীনের সঙ্গে কথা বলেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহসম্পাদক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমানে শোনা যায়, তরুণরা প্রযুক্তির আসক্তিতে মত্ত প্রযুক্তির আসক্তি ও এর প্রধানতম ক্ষতিটা আসলে কী?
কম্পিউটার, স্মার্টফোন, গেমিং সিস্টেম, বিশেষ করে পর্দায় কাজ করা সম্ভব এমন যেকোনো যন্ত্রের প্রতি তীব্র টানকেই প্রযুক্তির আসক্তি বলে মনে করি। তরুণদের মধ্যে এই আসক্তি খুব বেশি দেখা গেলেও সব বয়সের মানুষই এতে আসক্ত হতে পারে। এটা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দিকগুলো দুর্বল করে ফেলে।
প্রযুক্তি তো আমাদের উন্নত জীবনের পথ দেখায়; কিন্তু আপনি কি মনে করেন, এর আসক্তি মানুষকে ক্ষতি করে?
আজকের পৃথিবী প্রযুক্তিময়। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। মানুষের জীবন-জীবিকা এখন আরও সহজ, আরও বর্ণিল হয়ে উঠেছে। সন্দেহ নেই, প্রযুক্তির আলোয় আলোকিত আমাদের পৃথিবী। প্রদীপের নিচে অন্ধকার বলেও একটা কথা আছে। তেমনি এ প্রযুক্তির আছে কালো দিক। কথা ছিল, প্রযুক্তি দিয়ে কালো ফেলে ভালো নিয়েই এগিয়ে যাব আমরা। আফসোস, কেন যেন মানুষের মন ভালোর চেয়ে কালোর দিকেই ঝুঁকছে বেশি। তাই তো বিশ্বজুড়ে আজ কল্যাণের হাতিয়ার প্রযুক্তিকে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে অকল্যাণের মাধ্যম। প্রযুক্তি যত উৎকর্ষতা লাভ করছে, মানুষের নিরাপত্তা এবং জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ততই ফ্যাকাশে হয়ে পড়ছে। এ যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার মতো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের তরুণরা পর্যাপ্ত সময় অপচয় করে, এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ সামাজিক নানা মাধ্যম আজ তারুণ্যের সময়খেকো দানবে পরিণত হয়েছে। এটা বড় নির্মম সত্য, বিষয়টি নিয়ে আরও আগ থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। কিন্তু আমাদের অবস্থা এমন, বিষফোড়া ফুলে-ফেঁপে পেকে গেলে আমাদের হুঁশ হয়। ব্যথা হলে বলে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কিন্তু এর আগে যে দীর্ঘ সময় বিষফোড়া যন্ত্রণা দিচ্ছিল, তখন আর ডাক্তারের খবর নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করিনি। এটা আমাদের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আনন্দের কথা হলো, অনেক দেরি করে হলেও আমরা বুঝতে পেরেছি, নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলেও আসলে এগুলো চরম অসামাজিক এবং অমানবিক মানুষ বানানোর বড় হাতিয়ার হিসেবেও কখনও কখনও কাজ করে।
পারিবারিক বন্ধন শিথিলে প্রযুক্তিগত আসক্তির ভূমিকা আছে বলে মনে করেন?
প্রশ্ন ফাঁস থেকে শুরু করে অশালীনতায় জড়ানো এবং মাদকের আদান-প্রদানে পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে ফেইসবুকসহ সামাজিক নানা যোগাযোগমাধ্যম। তা ছাড়া ফেইসবুক এবং বিভিন্ন ভিডিও অ্যাপ যে কীভাবে নোংরামি আর অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেগুলো ভাবতে গেলেও আঁতকে উঠি। পরকীয়া, আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ যেসব সমস্যা আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে শিথিল করে দিয়েছে, স্বাভাবিক জীবনকে করেছে বিপর্যস্ত, তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এসবের পেছনে অনলাইনভিত্তিক চ্যাটিং সাইটগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের দুয়ারে বাংলাদেশ মুসলিম দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে কি-না, এ প্রশ্নের উত্তর এখন অনায়াসেই ‘না’ বলে দেওয়া যায়। মুসলিম তরুণরা মাদক-নারী আর ইন্টারনেটের নেশায় ডুবে গেলে সম্ভব হবে না গবেষণা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অবদান রাখা। তাহলে কীভাবে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি, একটি সমৃদ্ধ দেশ-জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকার?
ইন্টারনেটভিক্তিক চ্যাটিং ও গেমিং সাইটগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
যুবসমাজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ স্কুলপড়–য়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ বন্ধুটি পর্যন্ত ইন্টারনেটের লাল-নীল জগতে ডুবে থাকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে। কর্মজীবীরা চ্যাটিং-গেমিং করে নষ্ট করছে কর্মঘণ্টা। সংসার ভেঙে যাচ্ছে অনলাইন ডেটিং সাইটগুলোর কালো থাবায়। যখন দেশের অবস্থা এমন, তখন স্বাভাবিকভাবেই কপালের ভাঁজ পুরু থেকে আরও পুরু হচ্ছে দেশ ও সমাজদরদী মানুষের। তারা তাদের অবস্থান থেকে বারবার বলছেন, এখনই সময় ইন্টারনেটভিত্তিক চ্যাটিং ও গেমিং সাইটগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার। মহান সংসদের বাইশতম অধিবেশনেও বিরোধীদলীয় এক নেতা বলেছেন, ‘ফেইসবুক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হবে।’ আমরা আলেম সমাজও মনে করি, ইন্টারনেট ও চ্যাটিং সাইটগুলো নিয়ন্ত্র¿ণে আনার মাধ্যমেই সম্ভব অশ্লীলতা নামক দানবের হাত থেকে দেশ-জাতি বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা। এতে আগামীর বাংলাদেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
এ আসক্তি কী শিশুদেরও ক্ষতি করছে?
আমরা কিন্তু কিছুদিন আগেও শিশুদের হাতের প্রযুক্তিগত ডিভাইসগুলোর ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম না। কিন্তু কয়েক বছরে শিশুদের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আমাদের শিশুরা কান্নাকাটি করলে তাদের হাতে ডিভাইস দিয়ে শান্ত করি, যার কারণে শিশুর প্রতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এ আসক্তি থেকে উত্তরণের জন্য কী করা উচিত বলে মনে করেন?
মোবাইল ফোনের কারণে আজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মুখোমুখি আলাপ-আলোচনা। আপনজনের স্পর্শ থেকে মানুষ দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। মন খুলে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলবে, সে মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। তাই মানুষের স্ট্রেস ও উদ্বেগ বাড়ছে। তাই প্রযুক্তি আসক্তি থেকে বের হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা পরিবারের জন্য যে সময়টুকু রাখব, সে সময় স্কিন ফ্রি থাকতে পারি। সপ্তাহে কোনো একবেলা যন্ত্রের সঙ্গে না কাটিয়ে ভালো যা কিছু করতে মন চায়, করতে পারি। সামনাসামনি বসে কোনো আলাপ করতে পারি। বিশেষ প্রয়োজনে কতটুকু সময় ডিভাইসের সামনে থাকব, তা নির্ধারণ করে নিতে পারি। অনলাইনে পড়ার পাশাপাশি বই পড়াও অব্যাহত রাখতে পারি। ঘুমাতে যাওয়ার দুই-এক ঘণ্টা আগেই ডিভাইস থেকে আলাদা হতে পারি। সর্বোপরি বলব, আমরা যেভাবে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকি, তাতে মনে হয়, জীবনের সবটুকু সময় তাদের কাছে বিক্রি করেছি। এমনটি না করে সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে হবে।