বছরের মিলন মোহনায় করণীয়

আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জির একটি বছর বিদায় ও আরেকটি বছর আগমনের মিলন মোহনায় পালিত হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট। নিজস্ব সংস্কৃতি পরিপালনে খ্রিষ্টানরা বেশ ধুমধামের সঙ্গেই উদযাপন করে এ রাত। অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থার্টি ফার্স্ট নাইটের উৎসবে থাকে আতশবাজি, পটকাবাজি, মদ্যপান, নৃত্য পরিবেশন ও রকমারি খাবারের আয়োজনসহ গর্হিত, ঘৃণিত ও ন্যক্করজনক বহু ক্রিয়াকলাপ; যা ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না। ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘর ছুঁতেই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এর উচ্ছ্বসিত ধ্বনির মাধ্যমে শুরু হয় বর্ষবরণের এ উশৃঙ্খল আয়োজন ও নির্লজ্জ বিনোদন।

নববর্ষ ও মুসলমান

চরম উদ্বেগের বিষয় হলো, পশ্চিমা সংস্কৃতির গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে বহু মুসলমান যুবক-যুবতীও বর্ষবরণের উৎসবে মেতে ওঠে তারুণ্যের উন্মাদনায়। বেমালুম ভুলে যায় ইসলামের আলোকিত আদেশ, নিষেধ ও নীতি-নির্দেশনা। নেচে-গেয়ে, আনন্দণ্ডফুর্তি করে একটি বছরকে বিদায় দিয়ে আরেকটি বছরকে স্বাগত জানায়। একটুও ভাবে না বিজাতীয় অনুসরণের অশুভ পরিণামের কথা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৩১)। আরেক বর্ণনায় এসেছে, ‘যারা অন্যদের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, তারা আমাদের দলভুক্ত হতে পারে না।’ (তিরমিজি : ২৬৯৫)। ভিন্ন সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের এ প্রবণতা দেখে মনে হয়, চৌদ্দশ বছর আগে রাসুল (সা.) বুঝি আমাদের উদ্দেশ্যেই বলে গেছেন, ‘অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করবে প্রতি বিঘতে, প্রতি হাতে; এমনকি তারা যদি গুইসাপের গর্তেও প্রবেশ করে, তবু তাদের অনুসরণে তোমরা সে গর্তে প্রবেশ করবে।’ বর্ণনাকারী আবু সাঈদ (রা.) বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কি ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কথা বলছেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তারা না হলে আর কারা!’ (বোখারি : ৩৪৫৬)।

উল্লসিত হওয়া অনুচিত

প্রশ্ন হলো, কেন এ আনন্দণ্ডউচ্ছ্বাস? কেন এ নৃত্য-উল্লাস? জীবনের একটি বছর পার করে নতুন বছরের দোরগোড়ায় উপনীত হয়েছি এ জন্য? অথচ একটি বছর অতিক্রম করা মানে জীবনবৃক্ষের ৩৬৫টি পাতা ঝরে পড়া কিংবা জীবনপ্রাসাদের ৩৬৫টি ইট খসে পড়া। এতে আনন্দ প্রকাশের কী আছে! স্ফূর্তির রস নিংড়ানোর কী আছে! আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে তো বেদনাহত হওয়ার কথা। অর্থহীন কাজকর্ম ছেড়ে অর্থপূর্ণ কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা। কেননা, আমরা যতটুকু সময় পার করেছি, আমাদের দিকে মৃত্যু ততটুকু এগিয়ে এসেছে এবং পরকাল ততটুকু ঘনিয়ে এসেছে।

হিসাব নেওয়া চাই

নববর্ষের আগমনে উদ্বেলিত না হয়ে আমাদের উচিত, বিগত বছরের হিসাব কষা এবং পাপ-পুণ্যের পরিসংখ্যান করা; আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ও জীবনের অমূল্য সময়কে আমরা কতটুকু কাজে লাগিয়েছি? আখেরাতের জন্য কতটুকু পাথেয় সঞ্চয় করেছি? নাকি আল্লাহর নাফরমানিতেই জীবন-যৌবন বরবাদ করেছি এবং পাপ-পঙ্কিলতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেছি? ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘তোমাদের জীবনের হিসাব নেওয়া এবং তোমাদের আমল ওজন করার আগেই তোমরা নিজেরা নিজেদের হিসাব গ্রহণ কর এবং আমল ওজন কর। কেননা, আজ যদি তোমরা নিজেদের হিসাব নিতে পার, তাহলে আগামীকালের হিসাব তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই মহাদিবসের জন্য (ঈমান-আমলের মাধ্যমে) সজ্জিত হও, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর সামনে পেশ করা হবে। তোমাদের কোনো কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (মুহাসাবাতুন নাফস, ইবনে আবিদ দুনিয়া : ২)। বস্তুত যারা নিজেদের আমলের মোহাসাবা করে এবং জীবনের হিসাব গ্রহণ করে, তারাই বুদ্ধিমান। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে; আর নির্বোধ ওই ব্যক্তি, যে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছে আশা রাখে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অর্থই হলো হিসাবের দিন আসার আগে আগে নিজের হিসাব গ্রহণ করা।’ (তিরমিজি : ২৪৫৯)।

সময়ের হিসাব নেওয়া হবে

জীবনের হিসাব নিয়ে যদি আমরা নিজেকে সংশোধন না করি এবং ইসলামের অনুশাসন মান্য না করি, তাহলে কেয়ামতের দিন যখন আমাদের জীবন-যৌবন ও সময়-সম্পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেওয়া হবে, তখন ধরা খেয়ে যেতে হবে। আর ধরা খেয়ে গেলে ধ্বংস ও বরবাদি অনিবার্য। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন কোনো বান্দা সেই পর্যন্ত কদম বাড়াতে পারবে না, যতক্ষণ না তাকে চারটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে- ১. জীবন কোন কাজে ব্যয় করেছে? ২. যৌবন কোন পথে শেষ করেছে? ৩. সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে এবং কোন কাজে ব্যয় করেছে? ইলম অনুপাতে কতটুকু আমল করেছে?’ (তিরমিজি : ২৪১৬)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যার হিসাব কঠিন করে নেওয়া হবে, তাকে ধ্বংসের মুখে পড়তে হবে।’ (বোখারি : ১০৩)।