মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
মাদক প্রতিরোধে ইসলাম
শায়খ আবদুর রহমান বিন আবদুল আজিজ আস সুদাইস
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জাতি এখন ফেতনার ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত, নানামুখী ধ্বংসাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রতিটি ফেতনা ও চ্যালেঞ্জের গতি-প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। ফেতনার ভারি বর্ষণ চলছে, প্রবল গতিতে ধেয়ে আসছে চ্যালেঞ্জের ঝোড়ো হাওয়া। জাতির বুদ্ধি-বিবেক অকেজো করার ফেতনা সবচেয়ে ভয়ংকর; যা কখনও বুদ্ধি বিনষ্টকারী বিকৃত চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে হয়, আবার কখনও হয় মাদক ও নেশা জাতীয় বস্তুর বিস্তারের মাধ্যমে।
বুদ্ধি অনেক বড় নেয়ামত
বোধশক্তি আল্লাহতায়ালার উন্নত ও পবিত্রতম অনুগ্রহ। এর চেয়ে বড় ও মূল্যবান কোনো নেয়ামত আর হয় না। বোধ-বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, মর্যাদার উন্নতি হয়। এরই মাধ্যমে মানুষ ভুল-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকে। কবি বলেন, ‘আল্লাহর সবচেয়ে বড় দান বুদ্ধি-বিবেক। অন্য কোনো কল্যাণ মর্যাদায় এর ধারে-কাছেও নেই। দয়াময় যখন কারও বুদ্ধি-বিবেকে পূর্ণতা দান করেন, তার স্বভাব-চরিত্রও সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণতা লাভ করে।’
ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য
ইসলাম সহজ সরল স্বভাবজাত ধর্ম। মানুষের ইহ-পরকালীন কল্যাণ সাধনেই এর প্রতিষ্ঠা। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘শরিয়ত প্রণয়নের মৌলিক লক্ষ্য পাঁচটি- মানুষের দ্বীন, জীবন, বুদ্ধি, বংশ ও সম্পদের সংরক্ষণ। যেসব বিষয় মৌলিক এই পাঁচ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহযোগী হবে, তা-ই কল্যাণকর। আর যা এর বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তা-ই বিশৃঙ্খলা, অকল্যাণের কারণ। মানুষের ইহ-পরকালীন অকল্যাণ বয়ে আনে, এমন যে কোনো বিষয় আল্লাহতায়ালা হারাম করেছেন। এ কারণেই তিনি মদ ও নেশা জাতীয় দ্রব্য হারাম করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! নিশ্চয় মদ, জুয়া, পূজার বস্তু, জুয়ার তির- এগুলো অপবিত্র, শয়তানের কাজ। অতএব, তোমরা এর থেকে দূরে থাক; যেন সফল হতে পারে।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)। উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) মাদকতা আনে ও অবসাদগ্রস্ত করে, এমন সবকিছু থেকে নিষেধ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৬৬৩৪)। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা মদের ওপর অভিশম্পাত করেছেন- অভিশম্পাত করেছেন তা পানকারী, পরিবেশনকারী, বিক্রয়কারী, ক্রয়কারী, প্রস্তুতকারী, বহনকারী ও যার কাছে বহন করে আনা হয়, তাদের সবার প্রতি।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৬৭৪ )। কবি বলেন, ‘তুমি যুবক হয়ে থাকলে মদ পরিত্যাগ কর। বুদ্ধিমান কী করে উন্মত্ততার পথে ধাবিত হতে পারে?’
মাদকদ্রব্য বুদ্ধি নষ্ট করে
মাদকদ্রব্য মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের বিনাশ ঘটায়; তা হলো বুদ্ধি। এ কারণে আল্লাহতায়ালা মদ ও নেশা জাতীয় বস্তু হারাম করেছেন। বুদ্ধিমানের ওপর (পাগল নয় এমন) শরিয়তের বিধান আরোপিত হয়। তাই কোরআন-হাদিসে বুদ্ধি সংরক্ষণে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইমাম শাতেবি বলেন, ‘শরিয়ত প্রণয়নের একটি উদ্দেশ্য হলো, বুদ্ধি সংরক্ষণ, যা বুদ্ধিকে সংরক্ষণ করে, তা বৈধ; আর যা তাকে বিনষ্ট করে, তা অবৈধ।’
মাদকদ্রব্য শুধু সম্পদই নষ্ট করে না, জীবনও ধ্বংস করে। মাদকাসক্তি ব্যক্তিকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে পতিত করে। সম্মান নষ্ট করে। কখনও খুন-খারাবিও হয় এর কারণে। কোনো সমাজে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে গেলে সেখানে অপরাধের মাত্রাও সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। মাদকদ্রব্য মানুষের ধার্মিকতা ধ্বংস করে, বুদ্ধির বিলোপ ঘটায়, সুস্থতায় আঘাত হানে। দয়াময় আল্লাহর কাছে এটি চরম ঘৃণিত, মাদক সেবন শয়তানের কাজ, এটি মানুষের দ্বীন ও ঈমান দুর্বল করে দেয়। মাদকদ্রব্যের প্রসার কালের সবচেয়ে বড় বিপদ, এর ছোবল অত্যন্ত বিষাক্ত, জাতির জন্য ক্যান্সার। যে সমাজে মাদকদ্রব্যের প্রসার ঘটে, সেখানে সামাজিক শৃঙ্খলা বলতে কিছু থাকে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ফৌজদারি অপরাধের শতকরা চল্লিশ ভাগ এবং সামাজিক অপরাধের শতকরা ষাট ভাগ মাদকাসক্তির কারণে সংঘটিত হয়। কবি বলেন, ‘মাদকদ্রব্য যদি সমাজের দ্বিতীয় সমস্যা হয়, তাহলে মদ হলো সবচেয়ে প্রধান সমস্যা। এটি মূর্খতার ফাঁদ। হাজারও মানুষের মস্তিষ্ক এর কারণে বিকৃত হয়েছে।’
মাদকাসক্তির কারণ
মাদকদ্রব্য বিস্তারের কারণ অনুসন্ধান করলে বিশেষভাবে যুবসমাজের মাঝে আমরা দেখব, এর সবচেয়ে বড় কারণ ধর্মীয় বিধি-নিষেধ অনুসরণে শিথিলতা। অনেক জাতির কাছে সঠিকভাবে ইসলামি শিক্ষা উপস্থাপিত হচ্ছে না। বিরাট শূন্যতা এ ক্ষেত্রে। মানুষ নষ্টদের অন্ধভাবে অনুসরণ করছে, অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ছে। পাশাপাশি এ সময়ে অনেক সমাজে জ্ঞানার্জন ও কর্মমুখিতা থেকে নিস্পৃহ করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আরও ভয়ংকর বিষয় হলো, যুবক-যুবতীরা দুষ্ট বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ অসচ্চরিত্রমূলক বিষয় প্রচার করছে, নেশা জাতীয় দ্রব্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। প্রচার করছে, এর মাধ্যমে কর্মোদ্যম সৃষ্টি হয়, মস্তিষ্ক ঠান্ডা থাকে, বুদ্ধি পরিষ্কার হয়, মন-মেজাজে ফুরফুরে ভাব আসে। কেউ কেউ আবার বাজারজাত বা চোরাচালান করতে গিয়ে মাদকদ্রব্যের থাবায় আক্রান্ত হয়। একসময় তারও একটু সেবন করতে ইচ্ছে হয়। ফলে সেও এতে আক্রান্ত হয়। অনেকে তো একপর্যায়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে।
কত যে ধরন মাদকের!
যখন দ্বীনদারি বিলুপ্ত প্রায় হবে, শরিয়ত সম্পর্কে অজ্ঞতা বাড়বে, পুঁজির প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সমাজে মাদকাসক্তির মতো ব্যধি ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হয়ে যাবে। বর্তমানে এটি এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কত ধরনের মাদক যে দেখা যায়! তার শেষ নেই। গাঁজা, হাশিশ, পপি, ইয়াবা, আঠা, ড্রাগ, ইলেক্ট্রিক মাদক ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের ঘাস ও ফল; এমনকি গাড়ির টায়ার সংগ্রহ করে প্রস্তুতকৃত মাদকদ্রব্য। কবি বলেন, ‘যে নিহত বা ক্ষুধায় কাতর হলো, তার জন্য কেঁদো না। আগে মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা চিন্তা করে কাঁদো। সেই জীবনের চেয়ে তো মৃত্যুই শ্রেয়, যে জীবনে বুদ্ধিটাই সংরক্ষিত থাকল না। কে আছে আমার এ আহ্বান শ্রবণ করবে? সর্বনিকৃষ্ট ওই ব্যক্তি, যে সুস্থতাবিনাশী এ ভাইরাস খরিদ করে। আরও খারাপ সে, যে তা প্রস্তুত করে ও বিক্রি করে।’
মাদক প্রতিরোধে করণীয়
প্রথমে ব্যাধি চিহ্নিত করতে হবে। এর ভয়ংকর প্রভাব সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে হবে। এরপর এটি সমাজে গেড়ে বসার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। সার্বিকভাবে নির্মূলের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। সর্বপ্রথম ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে আল্লাহমুখী করতে হবে। আল্লাহর ধ্যান মানুষের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে। তার আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে সম্মানবোধ সৃষ্টি করতে হবে। সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের শরিয়ত আবাদ করে, ধ্বংস করে না। নির্মাণ করে, ভেঙে ফেলে না। সব ধরনের কল্যাণের প্রতি আহ্বান করে, সব অকল্যাণ ও বিশৃঙ্খলা থেকে নিষেধ করে।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে সুন্দর লালন-পালন ও চারিত্রিক শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। এটাই সঠিক ব্যক্তিত্ব বিনির্মাণের চালিকাশক্তি। এর মাধ্যমে বিশুদ্ধ মূল্যবোধ ও সুস্থ রুচিবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় আদর্শ রাসুল (সা.)। তবে মাদক প্রতিরোধে পরিবারের বিরাট ভূমিকা থাকা চাই। মা-বাবা, বিদ্যালয়, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা- সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এসবের পাশাপাশি অবশ্যই এর জন্য নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে; যাতে অন্যদের শিক্ষা লাভ হয়। যারা সমাজে এ মাদকাসক্তির ব্যাধি সংক্রমণের চেষ্টা করে, মাদক বাজারজাত করে, এর চোরাচালান করে, প্রচার-প্রসার করে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো প্রকার শিথিলতার আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না।
মাদক প্রতিরোধে সুধী সমাজের ভূমিকা
মাদক প্রতিরোধে আলেম, বক্তা, লেখক, বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, সাংবাদিক সবার ভূমিকা রাখতে হবে। সবাই দায়িত্বশীল; সবাইকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাব দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের বন্ধন সুদৃঢ় রাখতে হবে। সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী করতে হবে। যুবসমাজের বেকারত্ব দূরীকরণে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের বসে থাকতে দেওয়া যাবে না। নানা উপকারী প্রশিক্ষণ ও কোর্সে নিমগ্ন রাখতে হবে। যার যার জায়গা থেকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ধনী ও সরকারি আমলারাও এ ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব থেকে অসচেতন থাকতে পারেন না। কবির ভাষায়, ‘মদ ও নেশা-জাতীয় বস্তু ত্যাগ কর। করছি, করব বাদ দিয়ে এখনই ছেড়ে দাও। তোমার বুদ্ধি-বিবেক আল্লাহর আমানত। এর খেয়ানত কোরো না। হে ভাই! আমি আমার কথা বললাম। তুমি এখন বিষয়টি অবশ্যই ভালো করে চিন্তা কর।’
৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৪ (৩০ ডিসেম্বর ২০২২) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম