ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আল্লাহর স্মরণের গুরুত্ব ও প্রাপ্তি

আবদুল কাইয়ুম শেখ
আল্লাহর স্মরণের গুরুত্ব ও প্রাপ্তি

পৃথিবীতে কেউ যদি কারও উপকার করে কিংবা কারও ওপর অনুগ্রহ, দয়া ও অনুকম্পা করে, তাহলে তার নৈতিক দায়িত্ব হলো, সেই ব্যক্তির কথা স্মরণ রাখা, তার উপকারের কথা মনে রাখা, তাকে স্মরণ রাখার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তার অনুগত থাকা। আল্লাহতায়ালা আমাদের স্রষ্টা ও মালিক। আমাদের ওপর তাঁর উপকারের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। লালন-পালন করে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছেন। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের ওপর অনুগ্রহ করে চলেছেন। এমন অনুকম্পাশীল সত্তার কথা স্মরণ করা ও তাঁর উপকারের কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে তা মানুষের নৈতিক দায়িত্বও বটে।

স্মরণ রাখার ঐশী নির্দেশ

আল্লাহতায়ালা বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা ও মালিক। তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করে একে মানুষের বাসযোগ্য করেছেন। ফলে মানুষ পৃথিবীর বুকে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে। জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়। এ পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করার অপরিহার্য দাবি হলো, মানুষ তার স্রষ্টা ও পালনকর্তা মহান আল্লাহকে সব সময় স্মরণ রাখবে। আপন স্রষ্টা ও মালিককে ভুলে যাওয়ার অন্যায় ও অকৃতজ্ঞতা হতে বিরত থাকবে। তাই মহান আল্লাহ ঈমানদার বান্দাদের তাঁর কথা স্মরণ রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর।’ (সুরা আহযাব : ৪১-৪২)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা মহানবী (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেন, ‘আপনি এমন লোকদের সঙ্গে অবস্থান করুন, যারা আমাকে আহ্বান করে, আমার কথা স্মরণ করে, আমার জিকির করে। আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে আহ্বান করে। যারা পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে, তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং সীমা অতিক্রম করা যার কার্যকলাপ, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহফ : ২৮)।

আল্লাহকে স্মরণ রাখবেন

পৃথিবীর নিয়ম হলো, যদি বড় কোনো ব্যক্তি বা ক্ষমতাধর কোনো মানুষ সাধারণ কোনো ব্যক্তির কথা স্মরণ করে বা মনে রাখে, তাহলে সে অত্যন্ত খুশি হয়। একজন ঈমানদারের জন্য এর চেয়ে বড় খুশির বিষয় আর হতে পারে না যে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাকে স্মরণ করবেন এবং তার কথা মনে রাখবেন। আল্লাহতায়ালা এমন বান্দাদের কথা স্মরণ রাখেন, যারা তাঁর কথা স্মরণ রাখে বা জিকির করে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : ১৫২)।

যদি কিছু লোক একত্রিত হয়ে কোনো মজলিসে আল্লাহতায়ালার কথা স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের মজলিসে এমন লোকদের কথা আলোচনা করেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, মুআবিয়া (রা.) মসজিদে একটি হালকার উদ্দেশে বেরুলেন। এরপর তিনি বললেন, কীসে তোমাদেরকে এখানে বসিয়েছে? তোমরা এখানে বসেছ কেন? তারা বলল, আমরা আল্লাহর জিকির করতে বসেছি। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! এ ছাড়া আর কোনো বিষয় তোমাদের বসায়নি? তোমরা কি শুধু এ জন্যই বসেছ? তারা বলল, আল্লাহর শপথ! এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয় আমাদের বসায়নি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের অপবাদ দেওয়ার উদ্দেশে শপথ প্রার্থনা করিনি। রাসুল (সা.)-এর দৃষ্টিতে আমার যে সম্মান ছিল, সে অনুযায়ী আমার চেয়ে কম হাদিস বর্ণনাকারী কেউ নেই। একবার রাসুল (সা.) তার সাহাবিদের একটি হালকার কাছে গিয়ে বললেন, ‘কীসে তোমাদের বসিয়েছে?’ তারা বলল, ‘আমরা বসেছি আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। যেহেতু তিনি আমাদের ইসলামের পথ দেখিয়েছেন এবং আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! তোমাদেরকে কি শুধু এ বিষয়ই বসিয়েছে?’ তারা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমাদেরকে একমাত্র ওই বিষয় বসিয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে অপবাদ দেওয়ার জন্য শপথ করতে বলিনি; বরং আমার কাছে জিবরাইল (আ.) এসে আমাকে অবহিত করেছেন, আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের কাছে তোমাদের মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করছেন।’ (মুসলিম : ৬৭৫০)।

সৃষ্টিকুল আল্লাহকে স্মরণ করে

এ মহাবিশ্বে কত সৃষ্টি রয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, তরুলতা, সাগর, মহাসাগর ও খাল-বিলসহ এমন কোনো সৃষ্টি নেই, যা আল্লাহতায়ালার কথা স্মরণ করে না। বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি আল্লাহর কথা স্মরণ করে। এ ব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এসেছে, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহতায়ালার পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা সাফ : ১)। সৃষ্টিকুল আল্লাহকে স্মরণ করে মর্মে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, তার সবই রাজ্যাধিপতি পবিত্র পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে।’ (সুরা জুমা : ১)।

সাফল্য লাভ

পৃথিবীর নিয়ম হলো, যদি কেউ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, তার কথা স্মরণ করে, তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে, তাহলে সেই ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আনুকূল্য লাভ করতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কথা স্মরণ করে ও তাঁর কথা মনে রাখে, তাহলে আল্লাহতায়ালাও তাকে আনুকূল্য প্রদান করেন। তার জন্য সফলতা লাভের পথগুলো উন্মুক্ত করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় ও তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করে, এরপর নামাজ আদায় করে।’ (সুরা আলা : ১৪-১৫)। মহান আল্লাহকে স্মরণ করা সাফল্য লাভের উপায় মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা যখন কোনো বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন সুদৃঢ় থাক এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর, যাতে তোমরা উদ্দেশ্য লাভে সফল হতে পার।’ (সুরা আনফাল : ৪৫)।

পুণ্য লাভ

ইহকালের লাভ ও উপকারিতার কথা শুনলে আমরা অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠি; সেই উপকার কীভাবে অর্জন করা যায়, তার চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। অথচ ইহকালের জীবন ক্ষণিকের, আর পরকালের জীবন অনন্ত কালের। পরকালীন জীবনের একমাত্র পাথেয় হলো পুণ্য। আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করার মাধ্যমে এ পাথেয় খুব সহজেই অর্জন করা যায়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দুটি বাণী রয়েছে, যেগুলো দয়াময় আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। উচ্চারণে খুবই সহজ এবং আমলের পাল্লায় অত্যন্ত ভারী। (বাণী দুটি হচ্ছে- ) সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম। (অর্থাৎ আমরা আল্লাহতায়ালার প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। মহান আল্লাহ অতীব পবিত্র)।’ (বোখারি : ৭৫৬৩)। অন্য আরেকটি হাদিসে আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে অতিশয় পুণ্য লাভের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমর ইবনে শুআইব (রহ.) পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় একশত বার সুবহানাল্লাহ বলে, সে একশতবার হজ আদায়কারীর অনুরূপ। আর যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় একশত বার আলহামদুলিল্লাহ বলে, সে আল্লাহর পথে একশত ঘোড়া দানকারীর মতো অথবা তিনি বলেছেন, একশত জিহাদে অংশগ্রহণকারীর মতো। আর যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় একশতবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে, সে ইসমাঈল (আ.)-এর বংশের একশত দাস আজাদকারীর মতো। আর যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় একশতবার আল্লাহু আকবার বলে, সেই দিনের মধ্যে তার চেয়ে আর কেউ অধিক কিছু আমল উপস্থাপন করতে পারবে না। তবে যে ব্যক্তি তার অনুরূপ সংখ্যায় পড়েছে অথবা তার চেয়ে অধিক সংখ্যায় পড়েছে, সে ছাড়া।’ (তিরমিজি : ৩৪৭১)।

অন্তরের প্রশান্তি লাভ

বিভিন্ন সময় মানুষের অন্তর অস্থির থাকে। আপদণ্ডবিপদ, বালা-মসিবত ও সমস্যা-সংকটে বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতায় মানুষ ভোগে। কোনোভাবেই সে স্থির হতে পারে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েও তার অন্তর প্রশান্ত হয় না। এমন অস্থির চিত্তকে স্থির করা এবং অশান্ত চিত্তকে প্রশান্ত করার মহৌষধ হলো আল্লাহর স্মরণ ও জিকির। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার কথা স্মরণ করে বা তাঁর জিকির করে, তাহলে তার অন্তর প্রশান্ত হবে মর্মে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।’ (সুরা রাদ : ২৮)।

স্মরণ না করার পরিণাম

যেসব লোক আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে ও তাঁর জিকির করে, তিনি তাদের অন্তরে সঠিক বোধ-বিবেচনা গচ্ছিত করে দেন। পক্ষান্তরে যেসব লোক আল্লাহতায়ালাকে ভুলে যায় এবং তাঁর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আল্লাহতায়ালা তাদের আত্মবিস্মৃত করে দেন। ফলে এসব লোক কোন কাজে তাদের কল্যাণ রয়েছে এবং কোন কাজে অকল্যাণ রয়েছে, তা বুঝতে সক্ষম হয় না। তারা এমন সব কাজ আঞ্জাম দেয়, যেগুলো নিজেদের জন্য মন্দ পরিণতি ডেকে আনে। আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দেন। এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করেন, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহতায়ালাকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। তারাই অবাধ্য।’ (সুরা হাশর : ১৯)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত