শীত এলেই পরিযায়ী পাখি হয়ে উঠি যেন। ঘুরেফিরি ঢাকার অলিগলি। দেখি, জীবনের দ্রুততম ও শ্লথগতির সাম্পান। শহরের পথগুলো সব সময়ই বিচিত্র জীবনের সাক্ষী। তাদের সঙ্গে ভাগ বসাই। মননে এঁকে নিই নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ, দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট অসহায় মলিন মুখ। ভেতরটা কেমন ভেঙে আসে। সে সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। সাইন্সল্যাব থেকে শাহবাগের বিস্তৃত জ্যাম। গাড়ি ছেড়ে হাঁটাই গতি হয় তখন। গায়ে জড়ানো উলের জ্যাকেট, তার ওপর কাশ্মীরি শাল। মাথায় কানটুপি। তবু শীত মানে না। শীতল বায়ু বয়ে যায়। হাড়ে কাঁপন ধরে। আরও উষ্ণতার প্রয়োজন বোধ করি। হঠাৎ চাদরে টান পড়ে। পেছন ফিরে তাকাই। ছোট্ট মেয়েটির মুখ যেন শত বছরের পোড় খাওয়া মলিন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। তার দুই চোখজুড়ে জল। গায়ে ফিনফিনে কাপড়মাত্র। দুই হাতজুড়ে নেতানো ফুল। হাত কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। বয়স কত হবে! পাঁচ পেরিয়েছে হয়তো। তাকে কাছে টেনে নিই। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যাই। ছায়া ও বস্ত্রহীন এ ছেলে-মেয়েগুলোর গল্প প্রায় একই। প্রশ্ন করে বাড়াতে চাইনি ওর কষ্ট। সঙ্গে নিয়ে হাঁটি পল্টনের দিকে। একটা তৃপ্তির হাসি অন্তত ফুটুক।
দুই.
ক্যাম্পাসে সেদিন দেখলাম, কম্বলের স্তূপ। দূর থেকে পুরোনো মনে হলেও কাছে গিয়ে আবিষ্কার করি, নতুন। দায়িত্বশীল একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিই এগুলো আসার কারণ। এই শীতের রাতে যারা পথে ঘুমোয়, তাদের জন্য কেউ পাঠিয়েছে। রাত হলেই ক’জন শিক্ষার্থী বেরুবে এগুলো নিয়ে। বিলি করবে যতটা সম্ভব। আমি তাদের দলে ভিড়ে যাই। শীতে দ্রুতই যেন নিস্তব্ধতা নেমে আসে শহরে। জাঁকিয়ে বসে শীতের বুড়ি। আমরা পাঁচজন হাতে কম্বল নিয়ে হাঁটি। নতুন বাজার পেরুতেই বাঁশতলায় একজনকে পাই। ফুটপাতে শুয়ে আছে সটান। ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করছে মানুষটা। আওয়াজ শুনে বুঝতে পারি, একজন বৃদ্ধ। গায়ে পাতলা খাটো চাদর। মাথায় টেনে নিলে পা শূন্য হয়ে যায়, পা ঢাকলে মাথা খালি। ডাকতে গিয়ে বুঝি, কাউকে অভিশাপ দিচ্ছে মানুষটা। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তাকে। বকছে আবোলতাবোল। তার মাথায় হালকা করে হাত বুলিয়ে দিই। হুড়মুড় করে ওঠে বসে। ‘কে কে?’ চোখেমুখে একরাশ আতংক। আমরা তার দিকে এগিয়ে দিই একটা কম্বল। মুহূর্তেই কেঁদে ফেলে লোকটা। তার মুখ দেখে মনে হয়, অনেক কিছুই বলতে চাচ্ছে; কিন্তু কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। আমরা এগিয়ে যাই সামনে।
তিন.
পথ চলতে একটু চোখ-কান খুললেই এমন শত শত দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে আমরা দ্রুত সটকে পড়ি। ভাবি, জীবন চলুক জীবনের নিয়মে। অথচ ওই মানুষটা যাপন করছে এক মানবেতর জীবন। জীবনের প্রকৃত ছোঁয়া ওখানে থাকে না। ওখানে থাকে না লেপ থেকে মুখ তোলা অলস হাসি। জানালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে একটু বাতাস এলেই ‘উফ কী ঠান্ডা!’ বলার ভঙ্গিমা। তবুও কী বলব, জীবন চলেছে জীবনের নিয়মে!
চার.
মানবতার মুক্তির দূত রাসুল (সা.) সব সময় এসব বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। অসহায়, দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করতেন। একবার রাসুল (সা.) নামাজ পড়াচ্ছেন। সে সময় মুদার গোত্রের কিছু লোক মসজিদে নববিতে এলো। তাদের গায়ে কাপড় নেই তেমন। শুধু গলায় চামড়ার আবা ঝুলছে। নামাজ শেষে রাসুল (সা.) তাদের দেখলেন। তার চেহারায় বিষণ্নতা নেমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মিম্বরে দাঁড়ালেন। দান-সদকার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে উদ্বুদ্ধ করলেন। সাহাবায়ে কেরাম এত উৎসাহিত হলেন, মুহূর্তেই খাদ্য ও কাপড়ের স্তূপ হয়ে গেল সেখানে। সাহাবায়ে কেরামের এ উদারতা দেখে রাসুল (সা.)-এর মুখ ঝলমল করে উঠল। আনন্দের হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটজুড়ে। এরপর বললেন, ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে কাপড় দান করলে যতক্ষণ ওই কাপড়ের টুকরো তার কাছে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দানকারী আল্লাহর হেফাজতে থাকবে।’ (তিরমিজি : ২৪৮৪)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কেউ যখন অন্যের কল্যাণে নিয়োজিত থাকে, তখন আল্লাহও তার কল্যাণে রত থাকেন।’ (মুসলিম : ৬৭৪৬)।