জুমাবারের ফিচার
ইজতেমার হৃদয়ছোঁয়া গল্প
আবদুল্লাহ সরদার
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
একটি দীঘল রাত, তারপর কল্পতরুর ভোর। মুয়াজ্জিনের ডাকে ঘুম ভাঙে, যেমন হয় কপালে মায়ের শীতল ছোঁয়া পেলে। অচেনা রোদের মতো পাল্টে যায় বৃহস্পতিবারের দিনলিপি। ক্যাম্পাস ছুটি। তবু কিছু ছাত্রের আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে- ইজতেমায় যাবে তারা। আমিও ভিড়ি তাদের দলে। রাকিব, মাহমুদ আর আমি মিলেই শুরু হয় আমাদের যাত্রা। নতুন বাজার থেকে টঙ্গী- পথ কতদূর! ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে উঠে পড়ি অনাবিলে। ঝুলে থাকি বাঁদুড়ের মতো। অবাক করে দিয়ে বাস থেমে যায়। দু’মিনিটও এগোয়নি তখনও। ঝুলে থাকা মানুষগুলো নেমে যায় হুটহাট। কী হলো, কী হলো! গুঞ্জন ওঠে। বুঝতে বাকি থাকে না, এ আর এগোবে না গাড়িটি।
ঈমানের বাষ্পিত আবেগের ফুল অনুভব
ভাড়া চুকোইনি তখনও। নেমে পড়ি অগত্যা। আমাদের দেখাদেখি আরও মানুষ নামে। বাস খালি হয় নিমিষে। কেউ কেউ দূরের ভাড়া ফেরত নেয়। হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। খালি পেট হলেও ভোরে হাঁটার শক্তি অন্যরকম। পূর্ণোদ্যমে শুরু হয় হাঁটা। বারিধারা থেকে টঙ্গীর গাড়িগুলোর নড়াচড়ার আভাস নেই। পথ চলতে জেনে নিই ত্যাগের কিছু গল্প। বাসের জানালায় শত শত উৎসুক মুখ। তাদের চোখজুড়ে সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছুতে না পারার শঙ্কা। কেউ বাস থেকে নেমে হাঁটছে ঢাকার পথে। মনমরা এক কিশোরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কখন থেকে বসে আছ জ্যামে?’ ‘সাত ঘণ্টারও বেশি।’ তার উত্তর মেলে। সিলেট থেকে এসেছে। বাস-ট্রেন, ট্রাকে করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসা এ মানুষগুলোর এমন বিরক্তিকর সময়ে ধৈর্যের যে পরিচয় দিচ্ছেন, তা দেখে বড্ড অবাক হলাম। ভেতর থেকে তাদের ঈমানের বাষ্পিত আবেগের ফুল অনুভব করলাম।
সুযোগ বুঝে সিন্দাবাদের জিন্দাবাদ
গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিছু মানুষ। কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ মানুষটির পিঠেও ভর করে আছে বিরাট বেডিংয়ের বোঝা। তবু তার মুখজুড়ে ক্লান্তির ছাপ নেই। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা! কষ্ট হচ্ছে না?’ বলল, ‘কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না বাজান! সারাজীবন তো গোনাহই করলাম। বড়গো কাছে যাইয়া যদি কিছু শিখতে পারি, তাইলে শান্তিতে মরতে তো পারুম।’ কথা ক’টি বলেই ভিড়ল তার দলে। মুখে জিকিরের শব্দ। এয়ারপোর্ট পেরিয়ে উত্তরা, তারপর আবদুল্লাহপুর। আমাদের পথ যেন শেষ হয় না। টঙ্গীর কাছাকাছি এসে টের পাই, হচ্ছে না। পা ভেঙে আসে। ভেতরে খিদে চাউর দিয়ে উঠল। হোটেলে ঢুকলাম। পরোটা-ডাল অর্ডার করলাম। বিপদে পড়লে মানুষ এগিয়ে আসে সাহায্যে। বাঙালি চেষ্টা করে, ফাঁক-ফোকর দিয়ে লাভ করা যায় কি-না! বিশ টাকার ডালভাজি দ্বিগুণ দামে বিক্রি হলো। থতমত খেলাম হঠাৎ। এক যুবক রীতিমতো ঝগড়া বাঁধাল। আমরা বিল চুকালাম। রেখে এলাম ঘৃণাভরা দৃষ্টি। নিলাম তিক্ত অভিজ্ঞতা। এদের বোধোদয় হবে কোন কালে!
লাখো মুসল্লির মিলনমেলার স্বর্গীয় চিত্র
বাটা গেটে যখন পা রাখি, ৯টা বেজে ৫০ মিনিট। পৌনে তিন ঘণ্টা লাগল আমাদের পৌঁছুতে। তবু তৃপ্তির হাসি ফোটে। শেষতক পৌঁছাতে পারলাম! ইজতেমার এবারের চিত্র দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলাম ন। বাটা গেট ধরে সোজা যে পথ চলে গেছে ময়দানের দিকে, তার দু’পাশে অগণিত মানুষ। ভেতরে ঠাঁই মেলেনি তাদের। অগত্যা পথের পাশেই আশ্রয় নিয়েছে। এক বৃদ্ধকে বলতে শুনলাম, ‘এ তো বড় মজমা! এর জন্য এতটুকুন জায়গা! আরও কেন বাড়ায় না সরকার।’ আক্ষেপ ঝরে তার কণ্ঠ চিরে। মানুষের আক্ষেপের শব্দ, বেদনার সুর, আনন্দের হিল্লোল শুনতে শুনতে এগোই ময়দানে। ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয় লাখো মুসল্লির মিলনমেলার স্বর্গীয় চিত্র। অজুখানা থেকে পানি তুলছে কেউ, ধুয়ে নিচ্ছে হাতমুখ। কেউ কেউ রান্নার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এসব পেরিয়ে আমাদের গন্তব্য নামাজের মিম্বরে। ডেরা বাঁধব সেখানে। পথ অল্প, কিন্তু ভিড়ে মনে হয়, যেন হাজার বছর ধরে হাঁটছি। গেটের সামনে থেকে তোলা ম্যাপের ছবি বের করে খুঁজে নিই কাঙ্ক্ষিত জায়গা। আমাকে দেখে পুরনো বন্ধুদের সে কী উল্লাস! আমির সাহেবের কড়া নজর এড়িয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিলাম। বয়ান শুরু হয়নি তখনও। বয়ান হবে মাগরিবের পর থেকে। এ সময়টাতে দেখা-সাক্ষাৎ পর্ব সেরে নিলাম।
সবরে সরবে যাপিত সময়
আমাদের এক পরিচিত হুজুরের কাছে বসি। খোঁজখবর নেন তিনি। এমন সময় হাজির হন এক পৌঢ় লোক। হাসিমুখে স্বাগত জানান হুজুর। লোকটা মাদারীপুরের। থাকার ভালো জায়গা মেলেনি তাদের। একখানে বসেছিল, উঠিয়ে দিয়েছে পুলিশ। তাদের ঠাঁই হয়েছে তুরাগের ওপারে। ঠান্ডা বাতাস বয়। কত শত অভিযোগ তার! হুজুর শান্তমুখে সেসব শোনেন। তারপর বলেন, ‘কষ্টটুকু তো আল্লাহর জন্যই। দুটো দিনই তো। একটু ধৈর্য ধরুন। জানেন তো, সবরে মেওয়া ফলে। আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ তবু আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, যখন দেখি নামাজের ইকামত হচ্ছে, অথচ পানি নেই ট্যাঙ্কিতে। নতুন জায়গায় আসা মানুষগুলো ভ্রান্তিতে পড়ে। ওদিকে জামাত শেষ হয়ে যায়। কিছু মানুষ পানির জন্য হাহাকার করে। পানির এমন ঠুনকো ব্যবস্থা দেখে মন খারাপ হয়। নামাজে যখন পুরো মাঠ ভরে যায়, বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হয় রাস্তায়। এ সময়ের ফায়দা লোটার জন্যও কিছু মানুষ প্রস্তুত থাকে। সাধারণ পলিথিন বিক্রি করে চড়ামূল্যে। নিরুপায় মুসল্লিরা তা কিনতে বাধ্য হয়।
দলছুট হারিয়ে ফেলা সাম্পান
বিকেলটা বড্ড মলিন। মাগরিবের পর থেকে বয়ান শুরু। অপেক্ষা আর উত্তেজনা। চারদিকে জনসমুদ্র। জীবনের নানা চিত্র। এসব দেখার জন্য হলেও খিত্তা থেকে বেরোই। অদ্ভুত কিছু বাক্য সবার মুখে মুখে ফেরে, ‘যার যার ডানে চলি। জিকিরে ফিকিরে চলি। আল্লাহ আল্লাহ বলি।’ সবাই যার যার ডান পাশ ধরে হাঁটছে। মুখে উচ্চারিত হচ্ছে এ বাক্যগুলো। এ মিছিলে সেঁধিয়ে যাই। ধীরগতিতে হাঁটি। দ্রুত হাঁটার কোনো উপায় নেই যে! অনেকে পথ ভুল করে ভুল জায়গায় এসে দাঁড়ায়। মায়াময় মুখ করে তাকায়। জিজ্ঞেস করে, ‘খিত্তা নাম্বার ভুলে গেছি। বাড়ি কিশোরগঞ্জ। কই যাব?’ ম্যাপ দেখে তাদের পথ দেখিয়ে দিতে হয়। হারানো প্রাপ্তি নামে দুয়েকটা কামরা চোখে পড়ল তুরাগের তীরঘেঁষে। এ বিষয়টা ভালো লাগে। কারও কিছু হারিয়ে গেলে এখানে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মানুষ হারিয়ে গেলে! ইজতেমায় মানুষও হারায়। তাদেরও কেউ কেউ ঠিকানা না বলে পৌঁছে দেয় এ কামরাগুলোতে।
বয়ানের সাবলীলতায় জীবনের মোড়
সন্ধ্যা নামতেই ঠান্ডা বাতাস। কোনো রকম কাপড় দিয়ে বাতাস ঠেকানোর তুচ্ছ চেষ্টা। ওদিকে বয়ান শুরু হয়। মাইকে গমগম করে ওঠে উর্দু ভাষার চমৎকার কণ্ঠ; সঙ্গে বাংলা সাবলীল অনুবাদ। যেন কথা বলছে বাংলাতেই। বয়ান যিনি করেন, তার নাম উল্লেখ করা হয় না। কোনো গুরুরহস্য আছে নিশ্চয়। তাবলিগে যেসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত চর্চা হয়, সেগুলো নিয়েই সাধারণত কথাবার্তা বলেন ওলামায়ে কেরাম। সঙ্গে থাকে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ কারগুজারি। নিজ নিজ জায়গায় বসেই বয়ান শোনা যায়। জরুরি কথাগুলো কেউ কেউ মোবাইলে রেকর্ড করে, কেউ টুকে রাখে খাতায়। বয়ান শেষ হতেই শুরু হয় তাশকিল পর্ব; ফিলহাল জামাত বের করার কোশেশ। অনেক জামাত তৈরি হয়। ইজতেমা শেষ হতেই এরা ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে।