দেশের ভবিষ্যৎ চাহিদা, সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয় শিক্ষাব্যবস্থা। একজন নাগরিককে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও পেশাগত জীবনের দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তোলাই এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে পরিকল্পিত কর্মকাঠামো তৈরি করা হয়, তা হলো- কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম। পাঠ্যক্রমে থাকে সিলেবাস বা শিক্ষার্থীদের পড়ার তালিকা, শেখানোর নিয়মকানুন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি। আর বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় বা পাঠ্যসূচিতে যা সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, উদীয়মান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ পাঠ্যপুস্তক পড়ে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও পেশাগত জীবনের দায়িত্ব পালনে বিফল হবে। কারও কাজে তো আসবেই না, বরং জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাবে।
পাঠ্যক্রমে যেসব ক্ষতিকর পরিবর্তন
শিশুদের মন-মস্তিষ্ক থাকে একেবারে ফ্রেশ। তারা প্রথমে যা শোনে ও দেখে, তা-ই আজীবনের জন্য শেখে। আগে ছোটদের স্বরবর্ণে ‘অ’ দিয়ে ‘অজগর’ শেখানো হতো, এখন ‘অ’ দিয়ে অর্জুন; ‘আ’ দিয়ে ‘আল্লাহ’ থেকে এখন ‘আরাধনা’; ‘ই’ দিয়ে ‘ইবাদত’ থেকে এখন ‘ইসকন’; ‘এ’ দিয়ে ‘এক’ থেকে এখন ‘একাদশী’ শেখানো হচ্ছে। পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন এখানেই থমকে নেই। যখন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও সমাজ-রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব, তখনই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভাঙার ষড়যন্ত্র আরম্ভ হলো। প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসার প্রথম বর্ষের ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদে টুপি-হিজাব হটিয়ে দিয়েছে এবং আগে সালাম দিয়ে প্রথম পাঠ থাকলেও এখন ‘গুড মর্নিং’ দিয়ে পাঠ শুরু। স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির বই থেকে প্রিয়নবী (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির বই থেকে খলিফা আবু বকর (রা.)-এর জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ শেণির বই থেকে খলিফা ওমর (রা.)-এর জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির বই থেকে নবীজি (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বাদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সংযুক্ত হয়েছে ‘বই’ নামের একটি কবিতা; যা সম্পূর্ণ কোরআনবিরোধী। ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে সংযুক্ত হয়েছে ‘লাল গরু’ নামের একটি গল্প; যা মুসলমানদের গরুকে মা বলে সম্বোধন করতে বাধ্য করছে; পাশাপাশি ‘গরু জবাই করা মহাপাপ’ চিন্তার শিক্ষা দিচ্ছে। সপ্তম শ্রেণির বইয়ে সংযুক্ত হয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘লালু’ নামের গল্প; যা মুসলমানদের কালীপূজা করতে উদ্বুদ্ধ করছে। অষ্টম শ্রেণির বইয়ে সংযুক্ত হয়েছে হিন্দুদের ‘রামায়ণ’ নামের গ্রন্থ; যা সরাসরি মুসলমানদের হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছে।
অসাম্প্রদায়িকতার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতার বীজ
এখানেই শেষ নয়, সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত কোথাও আপত্তিমুক্ত নয়। প্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিমান যে কেউ বইটি পড়ামাত্রই বুঝতে পারবেন, পাঠ্যবই থেকে ইসলামি সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি তুলে দেওয়ার হীন মানসিকতায়ই এর লেখকরা মাঠে নেমেছে। তবে আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে বইয়ের নামটা ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বেমানান হয়েছে। বইয়ে লজ্জাজনক হারে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। ফলে মুসলিম শাসনব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। অতি কৌশলে হিন্দু, বৌদ্ধ সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশাপাশি মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। একদিকে হিন্দু, বৌদ্ধ ও বিধর্মীদের প্রশংসা, অপরদিকে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা! বেশ গোছালোভাবেই বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করতে সাহায্য করবে। রচয়িতাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভুল তথ্য দিয়ে হলেও ব্রিটিশ-পূর্ব মুসলিম শাসকদের হেয় করা, অন্য ধর্মের তুলনায় মুসলমানদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। এটা সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িকতা।
পাঠ্যপুস্তকের চৌর্যবৃত্তি কেউ কামনা করে না
‘নগরবধূ’ নামের একটি আজগুবি গল্প- যা কিশোর শিক্ষার্থীদের বেহায়া-বেলেল্লাপনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‘অবরোধবাসিনীর কাহিনী’ পাঠটি পড়লে বোঝা যায়, এগুলো লেখাপড়া নাকি অন্য কিছু! রচয়িতাণ্ডসম্পাদকরা দেশের সেরা বুদ্ধিজীবী দাবি করে এবার কপিরাইটেও ধরা খেয়েছে। শুরুতে যেভাবে লাইন টু লাইন অনলাইন ওয়েবসাইট থেকে কপি করে বাংলা অনুবাদ করেছে, সেটি দেখার পর মনে হয়েছে, আমরা ঠিক কোন শিক্ষাব্যবস্থা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছি? চোখ যতদূর যায়, তার অংশ এভাবে গুগল ট্রান্সলেটরে ভাষান্তর করা হয়েছে। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, গুগল আমাদের বাংলা ভাষা এখনও ভাষান্তর সঠিকভাবে করতে পারে না। ভুলভাল ইংরেজিতে বাংলার ভাষান্তর হয়। একজন গবেষক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের এমন চৌর্যবৃত্তি কেউই কামনা কর?তে পারে না। এটিকে একাডেমিক ভাষায় প্লেইজারিজম বলে; যা গুরুতর অপরাধ।
ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলন সংযোজনে ভয়াবহতা
বিবর্তনবাদের পরে এবার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হলো ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলন। এর অনুমোদন তৈরি করতে ব্যবহার করা হবে সায়েন্সকে। সায়েন্স নামক টুল দিয়ে প্রমাণ উৎপাদন, জার্নাল নামক উচ্চ ফান্ডিং বায়াস মিডিয়া দিয়ে সেটা মজবুতকরণ, গণমাধ্যম দিয়ে সেটাকে কাভারেজ দেওয়া। ব্যস। এ কারিকুলামটা এক বছর থাকলে হাজার হাজার ১০ থেকে ১২ বছরের শিশু (যার সম্মতি দেওয়ারই অধিকার নেই) বিপরীত লিঙ্গ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে। তাতে আমাদের আপনজন কেউ না কেউ থাকবে। আগে হলে হয়তো সে বাস্তবতা মেনে নিত, মনে উদয় হলেও ব্যাপারটাকে পাত্তা দিত না। ছোট থেকে রান্নাবান্না ভালো লাগলে হয়তো বড় হলে শেফ হতো, হোটেলে-কমিউনিটি সেন্টারে বাবুর্চি হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ত। এখন এ বই পড়ে সে চিন্তা করবে মেয়ে হওয়ার। আগে ছেলেদের খেলা ভালো লাগলে হয়তো প্রমীলা ক্রিকেটার হতো, এখন এ বই পড়ে চিন্তা করবে ছেলেতে পরিণত হওয়ার কথা।
ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সুকৌশলে উগ্র হিন্দুত্ববাদ
‘বিজ্ঞান’ বইয়ে পৌরাণিক কাহিনি উল্লেখ করে বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটিতে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে বিভিন্ন লজ্জাস্থানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে বয়ঃসন্ধিকালের নির্লজ্জ বর্ণনা ও বিকৃত, অবাধ যৌনতার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বইগুলোতে মুসলিম ও বাংলাদেশি সুস্থ-সংস্কৃতি উপেক্ষা করে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য নগ্ন সংস্কৃতিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সুকৌশলে উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রবেশ করানো হয়েছে। বর্তমান পাঠ্যপুস্তক শুধু ইসলামবিরোধীই নয়; বরং সরাসরি ইতিহাস বিকৃত ও দেশের ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শামিল। মুসলমান দূরের কথা; কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষও এ বিকৃত, নির্লজ্জ, উদ্ভট, বানোয়াট, কল্পিত বিষয়ের বইগুলোকে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে মেনে নিতে পারে না। বইপাঠ জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। যদি তা হয় ভুল বা বিকৃত ইতিহাস, আজগুবি ও কাল্পনিক গল্প, বাস্তববিরোধী কাহিনী, বিবর্তনবাদ, ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলন, ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত, অশ্লীল প্রবন্ধ, কপি রাইটসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত; তাহলে তা পড়ে কীভাবে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে? বরং জ্ঞানের পরিধি আরও সংকীর্ণ হবে। এ পাঠ্যপুস্তক আমাদের জন্য অশনিসংকেত, মেধাশূন্য করার গভীর ষড়যন্ত্র, নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ এতে মেঘে ঢাকা কালো এক অধ্যায়।