ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মানবতার মিছিলে দরদি অভিযাত্রী

তাবাসসুম মাহমুদ
মানবতার মিছিলে দরদি অভিযাত্রী

অসহায় সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে ইসলাম ব্যাপক নির্দেশনা ও উৎসাহ প্রদান করেছে। যে ব্যক্তি সুযোগ থাকার পরও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় না, তাকে আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। এরশাদ হচ্ছে, ‘কেয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পাশ ও পিঠ দগ্ধ করা হবে। (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা রেখেছিলে। সুতরাং এখন এর স্বাদ আস্বাদন কর।’ (সুরা তওবা : ৩৫)। এ আয়াতে ওইসব লোককে হুঁশিয়ার করা হয়েছে, যারা তাদের অর্থ-সম্পত্তির ব্যাপারে কৃপণতা করে, যারা মানুষের অসহায় সময়ে দান-সদকা করে তাদের পাশে দাঁড়ায় না। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.)ও কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন; সঙ্গে সঙ্গে দাতার সুসংবাদের কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, ‘দানশীল আল্লাহর নিকটবর্তী। আর যে আল্লাহর নিকটবর্তী হবে, সে জান্নাতের অধিবাসী হবে এবং মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠবে। জাহান্নাম থেকে বহুদূরে থাকবে। আর কৃপণ আল্লাহর থেকে দূরবর্তী। আর যে আল্লাহর থেকে দূরবর্তী, সে জাহান্নামের অধিবাসী। মানুষের কাছে অপ্রিয় এবং জাহান্নামের নিকটবর্তী। কৃপণ ইবাদতকারী থেকে আল্লাহর কাছে অজ্ঞ দানশীল অধিক প্রিয়।’ (তিরমিজি : ১৯৬১)। মানুষের অসহায় সময়ে দাঁড়ানো এমনই এক মানববন্ধুর নাম আবুল হাসান মুহাম্মাদ নোমান।

পরিচিতি ও মানবতার পথযাত্রা

১৯৪৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর বরিশাল জেলার (ভোলা) দৌলতখানের হাজীপুর ইউনিয়নে তালুকদার পরিবারে তার জন্ম। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানা সদর আলেকজান্ডারের শিক্ষা গ্রামে তার পৈতৃক বাড়ি। পিতা বিশিষ্ট সমাজসেবক ও চিকিৎসক আলহাজ মফিজুর রহমান (রহ.) বৃহত্তর রামগতি থানা তাবলিগ জামাতের আমির ছিলেন। দরদি মনের ধর্মপ্রাণ মরহুমা মা শামছুন্নাহার জগন্নাথ কলেজ (১৯৬৪-৬৬) বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এসআর হল শাখার সভাপতি এবং ঢাকা শহর ছাত্রলীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। নোমান ৫ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সবার বড়। স্ত্রী রাজিয়া বেগম একজন চিকিৎসক। একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান নেদারল্যান্ডসে পরিবেশ বিজ্ঞানে মাস্টার্স করে বর্তমানে গবেষণারত। দুই মেয়ে জাফরিন হাসান বাণিজ্যে মাস্টার্স ও জেরিন হাসান বিবিএ শেষ করে স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। নোমান বি-কম (১৯৬৬) পাস করে সিএ ফার্ম এ কাশেম অ্যান্ড কোম্পানি থেকে সিএ কোর্স সমাপ্ত করেন (১৯৭০)। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানকালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্স স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। সিএ পড়া অবস্থায় ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের (বেসরকারি হিসেবে ১০ লাখ লোক) প্রাণহানিতে ‘ধ্বংস থেকে সৃষ্টি’র স্লোগান নিয়ে রামগতি তথা বৃহত্তর নোয়াখালীতে ত্রাণ, পুনর্বাসন, পুনর্গঠন, উন্নয়ন ও মানবাধিকার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

মানবতা ও সাংগঠনিক কাজে নিয়োগ

এএইচএম নোমান বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা পল্লী উন্নয়ন সমবায় ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারী (১৯৭৩-৭৪) এবং রামগতি উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির (বিআরডিবি) প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘বিশ্বগ্রাম’ তথা ‘গুচ্ছগ্রাম’ কনসেপ্টের (১৯৭০-৭৪ রামগতি) প্রতিষ্ঠাতা ও বাস্তবায়নকারী। ‘ঢেঁকিঋণ’ তথা ক্ষুদ্রঋণ উদ্ভাবনে অন্যতম সংগঠক তিনি। কোস্টাল ফিসারফোক কমিউনিটি নেটওয়ার্কের (কফকন) প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারি ও পিপলস্ হেলথ মুভমেন্ট (পিএইচএম) বাংলাদেশ সার্কেলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন (২০০১-০৪)। মানবাধিকার নেটওয়ার্কিং সংস্থা বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের (বামাসপ) বহুবারের সভাপতি। ফেডারেশন অব এনজিওস ইন বাংলাদেশের (এফএনবি) সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) নীতি-নির্ধারণী নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। জাতীয় এনজিও ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুয়রের (র্ডপ) প্রতিষ্ঠাতা (১৯৮৭) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তিনি। ঢাকাস্থ লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং রামগতি উপজেলা সমিতির সাবেক সভাপতি। তিনি ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটি ও ভোলা জেলা উন্নয়ন ফোরামের সদস্য।

সমাজসেবা ও তার স্বীকৃতি

এএইচএম নোমান গরিব মায়েদের জন্য ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ প্রদান কার্যক্রমের উদ্ভাবক ও অনুশীলক (মে ২০০৫); যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০ বছর এক প্রজন্ম মেয়াদে দারিদ্র্য বিমোচনে মাতৃত্বকালীন ভাতা ও তৎকেন্দ্রিক ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কার্যক্রমের উদ্যোক্তা; যা বাংলাদেশ সরকার বাস্তবায়ন করছে। তিনি ‘মাতৃবন্ধু’ উপাধিতে (২০১১) ভূষিত হন। নোমান ‘সর্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ’ ও ‘স্বাস্থ্যগ্রাম’-এর প্রবক্তা। তিনি দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবহিতৈষী কাজে অবদান রাখার জন্য ফিলিপাইনভিত্তিক ‘গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার ২০১৩’ লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি এ সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ২০০৯ সালে জেলা সমাজকল্যাণ পরিষদ কর্তৃক লক্ষ্মীপুর জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী নির্বাচিত হন। দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমেচনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য জুনিয়র চেম্বার ইন্টান্যাশনাল জেসিআই) বাংলাদেশ কর্তৃক জিসিআই বাংলাদেশ শান্তি সম্ভব অ্যাওয়ার্ড ২০১৭ লাভ করেন। স্বাস্থ্য গ্রাম উদ্ভাবনীমূলক ও ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের জন্য তার পরিচালিত র্ডপ জাতিসংঘের পানিবিষয়ক পুরস্কার ২০১৩ লাভ করে। আমেরিকার শিকাগোতে ২০১৮ সালে তৃতীয় ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস কর্তৃক ‘মিডওয়াইফারি অ্যান্ড নিওন্যাটার নাসিং ২০১৮’ উপস্থাপন করার জন্য সম্মানি হিসেবে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

অবিস্মরণীয় কীর্তি ও গল্পকথা

কানাডার টরোন্টোতে সিটিসেল ওয়্যারলেস টেকনোলজি থেকে ২০১৮ সালে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন কাজে প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপচার্য কর্তৃক উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনর পক্ষ থেকে মাতৃবন্ধু হিসেবে ‘প্রচারহীন বীরত্ব’, ‘আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন স্বর্ণ পদক ২০১৮’, ‘জেসিআই পুরস্কার’ ও ‘মাতৃবন্ধু এএইচএম নোমানসহ অনেক উপাধি ও সম্মাননা প্রাপ্ত হন। তিনি ঢাকাস্থ কাঁঠালবাগান বাইতুল মাওলা জামে মসজিদের সেক্রেটারি ও আলেকজান্ডার রহমানিয়া জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি। দেশ-বিদেশে ৩, ১০, ৪০ (চিল্লা) তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন মাদ্রাসা ও নারী শিক্ষাসহ স্কুল-কলেজ, এতিমখানা ও মসজিদে আর্থিক সেবা দিয়ে থাকেন। দেশের উন্নয়ন-রাজনীতি ও মানবাধিকার অভিজ্ঞতা প্রসূত লেখা ‘চলো গ্রামে যাই (১৯৭২)’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প আওতায় স্বনির্ভর আন্দোলন ‘সামগ্রিকতার জন্য কিছু বিক্ষিপ্ত কথা’, ‘সময়ের মানচিত্র’, ‘দিন বদলের স্বপ্ন’, ‘ধ্বংস থেকে সৃষ্টি’ এবং ‘স্বপ্নের আঁতুড়ঘর : ভাঙা-গড়ার দৌলতখান’ এবং ‘চলার পথের কথা’ তার অন্যতম রচনা। অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক (৮০-৮৬)। তিনি লেখক ও কলামিস্ট। সাংবাদিক হাসানুল কাদিরের রচনায় ও শাওয়াল খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত তার জীবন-কর্ম ও অবদানবিষয়ক গ্রন্থ ‘মাতৃবন্ধু এএইচএম নোমান’-এ রয়েছে তার সমাজসেবা ও দরদি মানবতার সব অবিস্মরণীয় কীর্তি ও গল্পকথা। এএইচএম নোমান উন্নয়ন ও মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য জাপান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, হংকং, শ্রীলংকা, ভারত, নেপাল, সৌদি আরব, জর্ডান, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, কানাডা, জেনেভা, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, গিনি এবং নাইরোবি পরিভ্রমণ করেন।

জন্মদিনে আগামীর প্রত্যাশা

আসছে ১ ফেব্রুয়ারি তার জন্মদিন। জীবনের নানান সেবামূলক কর্মের মধ্য দিয়ে এবার তিনি ৭৭-এ পা রাখছেন। এ উপলক্ষে তিনি জানান, সারা দেশে ক্রমবৃদ্ধি হারে বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ লাখ মাকে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান করছেন। এ জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই তাকে। প্রতি মাসে ৮০০ টাকা হারের স্থলে একজন পোশাক শ্রমিকের মাসিক মজুরি হারের মতো এ ভাতাও ৭ হাজার টাকা করার জোরালো আবেদন জানাই। একই সঙ্গে ৪ বছর মেয়াদকে ৫ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা; যাতে সরকারি সংরক্ষিত তথ্য-ভান্ডার অনুযায়ী শিশুদের স্কুল-মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি শর্তসহ বাধ্যতামূলক করা যায়। তাহলে ঝরে পরা বা স্কুলে যায় না, এ কথা আর থাকবে না। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১০ উপজেলায় সফল বাস্তাবায়ন পাইলটকৃত মাতৃত্বকেন্দ্রিক স্বপ্ন প্যাকেজ মডেল প্রকল্প সারাদেশে বাস্তবায়নের জন্য দাবি জানাচ্ছি। এসডিজি ১নং এজেন্ডা দারিদ্র বিমোচনকে লক্ষ্য রেখে স্বাস্থ্য কার্ড, শিক্ষা কার্ড, বসতি ঘর, কর্মসংস্থান, পরিবেশ, সঞ্চয় প্লাস, ২০ বছর এক প্রজন্ম মেয়াদে বটম লাইনিং মা-কেন্দ্রিক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশে আর কোনো স্বাস্থ্যহীন, শিক্ষাহীন, ঘরহীন, কর্মসংস্থানহীন থাকবে না। এ মডেল দেশি-বিদেশি মূল্যায়ন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি অধিদপ্তরসহ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আনায়নে বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আস্থা জানান তিনি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার ১৫৭ পৃষ্ঠার ৮৩ সার্বিক লিখিত বক্তব্য অতি অর্থবহ, গুরুত্বপূর্ণ, যথাযথ ও মা-শিশু সহায়তা কর্মসূচিকে ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে ঘোষণা করায় আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এ কর্মসূচিকে মাতৃত্বের মাতৃগর্ভ থেকে জীবন-চক্রভিত্তিক সমাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর যে গুরুত্ব, তা ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ নামে পরিবর্তন করায় এর গভীরতা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। অতএব, আমরা আগ থেকেই সরকার কর্তৃক পরিচালিত ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ বা ‘মাতৃত্ব ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ নামই রাখার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ছাড়া জীবনে আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি প্রশান্তি বোধ করছি। আল্লাহতায়ালা আমাকে আরও বেশি দেশ ও মানবতার কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত