ইসলামি সভ্যতার বিকাশকাল থেকেই আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শত্রুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে আছে। এ জন্য আরব ও ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সচেতন নাগরিকদের জন্য আবশ্যিকভাবে সেসব মহান ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত, যারা যুগে যুগে তাদের শত্রুদের মোকাবেলা করে আসছেন। বিশেষত মামলুক শাসকরা আরব ও মুসলিম বিশ্বের জন্য শত্রুদের বিপক্ষে যে শ্রম ও কোরবানি দিয়েছেন, তা এক কথায় অনন্য। তবে তাদের সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য জীবনালোচনা ইতিহাসের পাতায় খুব কম আলোচিত হয়েছে অথবা লেখা হয়েছে। ফলে যুগপরিক্রমায় তাদের অনেকের আলোচনা বিস্মৃত হয়েছে। মহান সুলতান মানসুর কালাউন তেমনই একজন; যার সম্পর্কে ইতিহাসে নির্ভরযোগ্য তেমন বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় না। আর যা পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই বিকৃত। ফলে উম্মাহর এসব মহান বীরকে নিয়ে পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে প্রজন্মের অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে সত্য ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য সেসব বীরকে নিয়ে নির্ভরযোগ্য বিবরণ উপস্থাপন জরুরি। এ মহান উদ্দেশ্য নিয়েই মিসরের প্রখ্যাত ইতিহাস গবেষক নুরুদ্দিন খলিল ‘আল মামালিক আল মুফতারা আলাইহিম’ বা অপবাদে জর্জরিত মামলুকরা নামক একটি সিরিজে মিসর ও শামের কিছু মামলুক শাসকের ন্যায়পরায়ণতার বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যাদের শাসনকাল অতিবাহিত হয়েছে প্রায় হাজার বছর আগে। বাস্তবতা হচ্ছে, ইতিহাস উল্লিখিত মামলুকদের প্রতি সুবিচার করেনি। দেয়নি তাদের ন্যায্য প্রাপ্য। অথচ কত জ্বলজ্বলে তাদের কীর্তি-অবদান। এ সিরিজেরই চতুর্থ গ্রন্থ হচ্ছে, ‘আল মানসুর কালাউন : বিনাউল হাজারাতি’।
ইতিহাসবিদদের বর্ণনামতে, কালাউনের জন্ম ৬১৯ হিজরি বা ১২২২ খ্রিষ্টাব্দে। মামলুকদের সচরাচর অবস্থার মতো কিপচাক তুর্কিদের আবাসভূমি ককেশাসে বা কৃষ্ণসাগরের উত্তরাঞ্চলে সুলতান কালাউনের জন্মভূমি। তবে সেখানে তার শৈশব বা বেড়ে ওঠা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৬৩৭ হিজরি ও ১২৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কালাউন দাসত্ব বরণ করেন। এ সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। এ তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, উঠতি যৌবনে কোনো এক যুদ্ধে তিনি বন্দি হন। পরে দাসব্যবসায়ীরা তাকে আইয়ুবি শাসনাধীন কোনো এলাকায় সুলতান কামিলের পরিবারের এক সদস্যের কাছে বিক্রি করে দেয়। সুলতান আলাউদ্দিন আক সানকার কালাউনকে দেখেই তার চেহারার আভিজাত্য, দৃঢ় প্রত্যয় আর তেজস্বী চিন্তার ছাপ ইত্যাদিতে মুগ্ধ হন। সর্বোচ্চ মূল্য পরিশোধ করে হলেও তাকে কেনার সিদ্ধান্ত নেন। দর কষাকষির একপর্যায়ে ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাকে কিনে নেন। তখন থেকে কালাউন ‘এক হাজারি লোক’ নামে প্রসিদ্ধ হন। সুলতান আলাউদ্দিন মুত্যুবরণ করলে তিনি সুলতান নাজমুদ্দিন আইয়ুবের দাসদের অন্তর্ভুক্ত হন।
সুলতান মানসুর কালাউন ছিলেন মানবসভ্যতা বিনির্মাণের মূর্তপ্রতীক। স্বদেশ রক্ষা ও মোঙ্গল-ক্রুসেডার শত্রুকে প্রতিহত করার যে অনুপম দৃষ্টান্ত আগের তিনজন মামলুক সুলতান রেখে গেছেন, সুলতান কালাউনও সে পথেই যে হেঁটেছেন, বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে সেটা দেখা যাবে। অধিকন্তু তিনি জনসাধারণের মধ্যে কিছু কার্যকর ও বহুমাত্রিক সভ্যতার পরশ জড়িয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ইসলাম ও মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, দখলদার ঔপনিবেশিকদের প্রতিহত করে ভূখণ্ডগুলো ফিরিয়ে আনা সভ্যতার বিচারে বুনিয়াদি একটি কাজ। মূলত বাইবার্সের রাজনৈতিক রীতিনীতির ওপরই ছিল তার পথচলা। মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ রূখে দিয়ে আরববিশ্বকে তাদের অনিষ্ট থেকে মুক্তি দেন। তিনি সম্রাট রোডলফ হাপসাবার্গসহ (জঁফড়ষঢ়য ড়ভ ঐধঢ়ংনঁৎম) ইউরোপীয় অন্যান্য শাসকের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। সুলতান বাইবার্স সভ্যতা বিনির্মাণের যে সূচনা করেছিলেন, কালাউন সেটার ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন। তিনি ১২৮৪-১২৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মুয়িজ রাস্তার পাশে হাসপাতাল, মসজিদ ও কবরস্থান-সংবলিত কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। কায়রোতে এখনও মামলুক শাসনামলের অনিন্দ্য সুন্দর নির্মাণশিল্পের সাক্ষী হিসেবে তা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তুর্কি মামলুকদের পরিবর্তে সারকাসি মামলুক (সিরিয়া ও জর্দান এলাকার প্রাচীন জনগোষ্ঠী)-দের কাছে টানেন। দুর্গের ভেতরের বিশাল গোলাকার ভবনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন।
বক্ষ্যমান গ্রন্থটি মহান সুলতান কালাউনের বর্ণিল জীবনালেখ্য নিয়ে রচিত। লেখক নুরুদ্দিন খলিল অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সুলতানের বর্ণাঢ্য জীবনচিত্র। সুলতান কালাউন এমন শাসক ছিলেন, যিনি মিসর ও প্রাচ্যে মানবসভ্যতা পুনর্র্নিমাণের বীজ বপনে এককভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। গ্রন্থটিতে আরও আলোচিত হয়েছে মোঙ্গলদের যুদ্ধাভিযান প্রতিহত করা, ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা ও তাদের হাত থেকে অনেক দুর্গ-শহর ছিনিয়ে আনার প্রচেষ্টার বিবরণ। গ্রন্থটিতে আরও জানা যাবে সুলতান কালাউন কীভাবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন! হাজার বছর পরেও টিকে থাকা সেই হাসপাতাল তৈরিতে তিনি কীভাবে এগিয়ে এসেছিলেন! দেখা যাবে মসজিদণ্ডমাদ্রাসাসমূহ সংরক্ষণে তার অবিস্মরণীয় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ। শুধু আপন রাষ্ট্রেই নয়; বরং এর বাইরে মসজিদে নববি পর্যন্ত যা বিস্তৃত ছিল। সুলতান কালাউন যখন ইন্তেকাল করেন, তখন শতবর্ষ নেতৃত্ব দানকারী একটি পরিবার রেখে যান। যার বংশধররা শত বছর পর্যন্ত তার যোগ্য উত্তরাধিকার ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এ জন্য তাকে ‘আবুল মুলুক’ বা ‘বাদশাদের পিতা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১২৯০ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর সুলতান কালাউন অসুস্থ হন এবং ১০ নভেম্বর কায়রো থেকে পাঁচ মাইল দূরের একটা এলাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি ছেলে আল আশরাফ খলিলকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ স্যার স্টিফেন রান্সিম্যান সুলতানের ব্যাপারে লেখেন, ‘তিনি ছিলেন একজন মহান সম্রাট। দৃঢ়তা ও কঠোরতায় ছিলেন বাইবার্সের সমপর্যায়ের। নিষ্ঠা ও আভিজাত্যে তিনি বরং তার থেকেও উচ্চমার্গে পৌঁছেছিলেন। পাশাপাশি বাইবার্স থেকে তার পৃথক বৈশিষ্ট্য ছিল যে, কালাউন তার যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে ছেলে আল আশরাফ খলিলকে রেখে যান; যিনি অদূর ভবিষ্যতে হবেন স্বমহিমায় ভাস্বর।’
বই : সুলতান মানসুর কালাউন
রচনা : নুরুদ্দিন খলিল
অনুবাদ : হামিদুর রহমান মাদানি
সম্পাদনা : ইলিয়াস মশহুদ
প্রকাশক : কালান্তর প্রকাশনী
পরিবেশক : রকমারি, ওয়াফি লাইফ, রেনেসাঁ
পৃষ্ঠা : ১০৪
মুদ্রিত মূল্য : ১৮০ টাকা