প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি শ্বাস-নিঃশ্বাসে আমাদের ওপর রবের নেয়ামত বর্ষিত হচ্ছে। অফুরন্ত সে নেয়ামত। জাহেরি, বাতেনি, জানা, অজানা- নানা কিসিমের নেয়ামতে ডুবে আছি আমরা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তিনি, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন, যিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন; আর তা দ্বারা উৎপন্ন করেন তোমাদের আহার্যের জন্য নানা ধরনের ফল। যিনি নৌযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন; যাতে তাঁর নির্দেশে তা সমুদ্রে বিচরণ করে। যিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন নদীগুলোকে। যিনি নিয়োজিত করেছেন চন্দ্র ও সূর্যকে; যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী হয়ে চলাচল করে। যিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন দিনরাতকে। তোমাদের যিনি দান করেছেন তোমাদের প্রার্থিত সব বস্তু থেকে। তোমরা যদি তাঁর নেয়ামত গণনা করতে চাও, তাহলে তা আয়ত্ত করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অতিশয় জালেম ও চরম অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩২-৩৪)।
নেয়ামত সম্পর্কে জানতে হবে
কোরআন আমাদের মৌলিক নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যাতে আমরা এর ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য নেয়ামত নিয়ে চিন্তা করতে পারি। এগুলো কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র। সব নেয়ামতের আলোচনা এখানে হয়নি। আয়াতে আল্লাহর নানা ধরনের নেয়ামত নিয়ে চিন্তা-ফিকিরে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহর নেয়ামত আমরা গুণে শেষ করতে পারব না। নেয়ামতের সংখ্যা তো দূরের কথা, শুধু তার ধরনগুলোই গণনা সাধ্যের বাইরে মানুষের। নেয়ামত সম্পর্কে না জানলে, মানুষ তার শোকরিয়া কীভাবে আদায় করবে? এ জন্য আগে আল্লাহর নেয়ামত সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে হবে। সেজন্য চোখ বুজে ধ্যান করতে হবে তাঁর নেয়ামতরাজির। রাসুল (সা.) যিনি সবচেয়ে আল্লাহভীরু, সর্বাধিক কৃতজ্ঞ বান্দা- তিনি আল্লাহর নেয়ামত সম্পর্কে বলছেন, ‘আপনার প্রশংসা করে শেষ করতে পারব না। আপনি তেমনই, যেমন আপনি নিজের প্রশংসা করেছেন।’ (মুসলিম)।
পূর্ণ শোকরিয়া আদায় করা অসম্ভব
নেয়ামত শুধু কিছু পাওয়ার নামই নয়; বরং বিপদ থেকে মুক্তিও অনেক বড় নেয়ামত। আল্লাহতায়ালা প্রতিদিন আমাদের অসংখ্য বিপদ থেকে হেফাজত করেন। মানুষের শরীরে সামান্য সমস্যা দেখা দিলেও জীবন কেমন মলিন হয়ে পড়ে। সারা দুনিয়া ব্যয় করে হলেও মানুষ সে সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চায়। ইবনে কাসির (রহ.) এ আয়াত (যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তা আয়ত্ত করতে পারবে না)- এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা নেয়ামত গণনায় মানুষের অক্ষমতার সংবাদ দিচ্ছেন। শোকরিয়া আদায় তো দূর কি বাত!’ তলক ইবনে হাবিব (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর হক অনেক ভারী, বান্দার জন্য তা পুরোপুরি আদায় করা অসম্ভব। আল্লাহর নেয়ামত অফুরান, বান্দা তা গুণে শেষ করতে পারবে না।’ শাওকানি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা মানুষের অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে যত রকমের নেয়ামত দান করে রেখেছেন, কেউ যদি তা গুণতে চায়, কখনোই গুণে শেষ করতে পারবে না। সম্ভবই নয় এটা। এ ছাড়া অন্য নেয়ামতের কথা না-ই বলা হলো। মানুষের ওপর প্রতি মুহূর্তে কত ধরনের নেয়ামত বর্ষিত হচ্ছে, কত যে প্রকার তার, কে তা গুণে শেষ করতে পারে?’ তিনি আরও বলেন, ‘মানব-শরীরের যে কোনো স্থানে, সামান্যতম সমস্যা দেখা দিলে মানুষের জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। নিজের যা আছে, সব ব্যয় করে হলেও সে সেই সমস্যা দূর করতে চায়। আল্লাহতায়ালা মানুষের শরীর প্রত্যেকের উপযোগী করে পরিচালনা করেন। মানুষ জানেও না, আল্লাহর কত নেয়ামত তার শরীরে প্রবাহমান। না জানলে কেমনে তার জন্য শোকরিয়া আদায় করে শেষ করা সম্ভব?’
শোকরিয়া আদায়ে মানবের স্বভাব
আয়াতের একেবারে শেষে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় মানুষ অতিশয় জালেম ও চরম অকৃতজ্ঞ।’ এটা মানুষের স্বভাব- মানুষ অকৃতজ্ঞ, নিজের ওপর জুলুমকারী, আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকারকারী, গোনাহের সাহস করে, আল্লাহর হক নষ্ট করে; আল্লাহ যত নেয়ামত দেন, কাফেরদের অকৃতজ্ঞতা তত বৃদ্ধি পায়। তারা নেয়ামতদাতার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইবাদত করে এমন বস্তুর, যা না কোনো উপকার করতে পারে, না কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে। না জীবন দিতে পারে, না জীবন নিতে পারে। আল্লাহর নেয়ামতের শোকরিয়া খুব কম বান্দাই আদায় করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দাদের মাঝে খুব কমই আছে, যারা কৃতজ্ঞ।’ (সুরা সাবা : ১৩)।
কম আমলেও অনেক প্রতিদান দেন
আমরা আল্লাহর অসংখ্য অগণিত নেয়ামতে ডুবে আছি। তিনি আমাদের ওপর সব নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় আবশ্যক করে দেননি। তিনি জানেন, বান্দা সেটা পারবে না। বান্দার দুর্বলতা ও অক্ষমতা সম্পর্কে তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তিনি ক্ষমাশীল। অনেক ক্ষমা করেন। খুব কম আমলেও অনেক প্রতিদান দান করেন। অতএব, বান্দার সর্বদা তাঁর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায়ে ব্যাপৃত থাকা উচিত, গোনাহ হয়ে গেলে ক্ষমা প্রার্থনা করা চাই।
১১ রজব ১৪৪৪ (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম