দেনমোহর ও প্রচলিত সমাজ ভাবনা
মাওলানা শিবলী নোমানী
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দেনমোহর একটি ফরজ বিধান। ইসলামি সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ফরজ বিধান আদায়ে আমাদের সমাজ নানা ধরনের প্রান্তিকতা ও প্রতিকূলতার শিকার। এ বিষয়ে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা অনেকেরই অজানা। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, এ ফরজ বিধান আদায়ে এমন অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, যা ইসলামের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়; অনেক সময় হারামে পর্যবসিত হয়। একজন দায়িত্ববান সচেতন মুসলমান হিসেবে দেনমোহর বিষয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রত্যেকেরই জন্য ফরজ পরিমাণ দ্বীনি ইলম শেখারই অংশ।
ইসলামের দৃষ্টিতে দেনমোহর
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(কয়েকজন নারী ছাড়া) অন্যদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে- যে স্বীয় সম্পদ দ্বারা প্রয়সী হবে তাদের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে, ব্যভিচারে নয়।’ (সুরা নিসা : ২৪)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘নারীদেরকে খুশি মনে তাদের দেনমোহর আদায় কর।’ (সুরা নিসা : ৪)। এ আয়াতদ্বয়ে বিয়ে ও দেনমোহর সম্পর্কিত বেশ কিছু মৌলিক দিকনির্দেশনা রয়েছে। যেমন- ক. ‘মুহাররামাত’ (যাদের সঙ্গে বিয়ে হারাম করা হয়েছে) ছাড়া অন্যদের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। খ. দেনমোহর একটি ফরজ বিধান। দেনমোহর আদায়ের নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। গ. স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য স্বেচ্ছায় ধার্যকৃত দেনমোহর থেকে ছেড়ে দেওয়া কিংবা বাড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি রয়েছে। ঘ. স্বামী যদি চাপ প্রয়োগ করে কিংবা কৌশলে পূর্ণ দেনমোহর বা আংশিক মাফ করিয়ে নেয়, তাহলে আল্লাহর বিচারে মাফ হবে না।
প্রচলিত সমাজ ভাবনা
দেনমোহর নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত যেসব কালচার রয়েছে, তা হলো- ১. নারীর মালিক বনে যাওয়া : দেনমোহর প্রকৃতপক্ষে নারীর সম্মানী; যা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদান করা হয়। দেনমোহরের মূল উদ্দেশ্য হলো, নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটি নারীর মূল্য নয় যে, এটি পরিশোধের মাধ্যমে ধরে নেওয়া হবে যে, স্ত্রী-স্বামীর কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।
২. দেনমোহর প্রথা সর্বস্ব বিধান নয় : দেনমোহর প্রথা সর্বস্ব কোনো বিষয় নয়, যা ধরা হয় কিন্তু আদায়ের প্রয়োজন পড়ে না। আমরা দেনমোহর ধার্যের প্রয়োজন অনুভব করলেও দেনমোহর পরিশোধের প্রয়োজন অনুভব করি না। গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধানটি অনাদায় রেখে দেওয়া আমাদের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। শরিয়ত দেনমোহর আদায়ের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত অন্যান্য গিফট বা হাদিয়া-তোহফার মতো দেনমোহর সাধারণ কোনো উপহার নয়। একই সঙ্গে দেনমোহর আদায় করা বা না করা স্বামীর ইচ্ছাধীন কোনো বিষয় নয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে দেনমোহর একটি স্বতন্ত্র আদায়যোগ্য আর্থিক ঋণ। অনাদায়ে ব্যক্তি মারা গেলে পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের আগে অন্যান্য ঋণের মতো স্ত্রীর দেনমোহর আদায়ে শরিয়ত নির্দেশ দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বিয়ে করেছে, অথচ দেনমোহর আদায়ের ইচ্ছা করে না, সে আল্লাহর কাছে কেয়ামতের দিন ব্যভিচারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১৬৩৮)। সুতরাং দেনমোহর যেন কাগুজে লেনদেনের মাঝের সীমাবদ্ধ না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
৩. স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া : বাসর রাতে বা পরবর্তী সময়ে স্ত্রীর কাছে দেনমোহর ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। শুধু তাই নয়, কনের অভিভাবকরাও কনেকে দেনমোহর ক্ষমা করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ফলে কনে লজ্জা, সংকোচবোধ ও অভিভাবকদের পরামর্শের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার দ্বারা দেনমোহর আদায়ের ফরজ বিধান থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় না। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/৩১৩)। দেনমোহর ক্ষমা করে দেওয়ার পরামর্শ প্রদান অভিভাবকদের জন্য কখনোই উচিত নয়। এটি অন্যায় পরামর্শের অন্তর্ভুক্ত। একইভাবে স্বামীর জন্যও স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া অত্যন্ত লজ্জা ও নীচু মানসিকতার পরিচয়ক। আত্মমর্যাদাশীল ও দায়িত্ববান স্বামীর পক্ষে কখনও স্ত্রীর থেকে দেনমোহর ক্ষমা চেয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
৪. বিজোড় সংখ্যায় দেনমোহর নির্ধারণ : ইসলামে মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারিত। তবে সর্বোচ্চ দেনমোহর নির্ধারিত নয়। (শরহু মুখতাসারিত তহাবি : ৪/৩৯৮)। ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন বিজোড় সংখ্যায় দেনমোহর নির্ধারণের প্রথা রয়েছে, যেমন- এক টাকা দেনমোহর ধার্য করা কিংবা এক লাখ এক টাকা ইত্যাদি। এটিকে জরুরি মনে করা সঠিক নয়।
শরিয়তের দৃষ্টিতে বেশি দেনমোহর নির্ধারণ
মোটা অঙ্কে দেনমোহর ধার্য করা হারাম নয়। কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি সঠিক নিয়তে আদায়ের উদ্দেশ্যে মোটা অঙ্কের দেনমোহর ধার্য করেন, তাহলে তার বিয়ে বরকত শূন্য হয়ে যাবে, এ কথা সঠিক নয়। সুরা নিসার ২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা অধিক দেনমোহর প্রসঙ্গে ‘কিনতার’ শব্দ উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই অধিক দেনমোহরে বিয়ে করেছেন। যেমন- ওমর (রা.) উম্মে কুলসুম (রা.)-কে চল্লিশ হাজার দিরহামে বিয়ে করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) দশ হাজার দিরহামে বিয়ে করেছেন। (তাবয়িনুল হাকায়েক : ৩/১৩১)। তবে আমাদের সমাজে অধিক পরিমাণে দেনমোহর ধার্যের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও লোক দেখানোর মানসিকতা থেকে মোটা অঙ্কের দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেখানে দেনমোহর আদায়ের ইচ্ছে থাকে না, সে ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের দেনমোহর নির্ধারণ নাজায়েজ। বেশি দেনমোহর নির্ধারণের জন্য তিনটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, লৌকিকতার উদ্দেশ্যে না হওয়া, দেনমোহর আদায়ের সদিচ্ছা ও পরিশোধে সামর্থ্যবান হওয়া। (ইমদাদুল মুফতিন : ২/৪৭১)।
শরিয়তের দৃষ্টিতে কম দেনমোহর নির্ধারণ
ইসলাম নারীর সম্মান রক্ষা করে কম দেনমোহর নির্ধারণে উৎসাহ প্রদান করেছে। সর্বোত্তম পরিমাণের দেনমোহর হচ্ছে তা, যা পরিশোধ করা সহজসাধ্য। (সুনানে বাইহাকি : ১৪৭২১)। রাসুল (সা.) অল্প দেনমোহরকে উত্তম ও বিয়েতে বরকতের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া দেনমোহর পরিমাণে কম হলে সমাজে বিয়েশাদি সহজলভ্য হয়ে যাবে। ফলে যুবকদের জন্য বিয়ের রাস্তা মসৃণ হবে। যে সমাজে বিয়ে যত বেশি সহজ, সে সমাজে পাপাচার ও অশ্লীলতার চর্চা ততটাই কম। এ জন্য নারীর সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রেখে যথাসাধ্য অল্প পরিমাণে দেনমোহর নির্ধারণ করা উচিত।
মোহরে ফাতেমি
রাসুল (সা.)-এর অধিকাংশ স্ত্রী ও ফাতেমা (রা.)-এর দেনমোহর ছিল পাঁচশত দিরহাম; যা বর্তমানে ১৩১.২৫ তোলা বা ১.৫৩০৯ কিলোগ্রাম রুপা। (শরহু মুখতাসারিত তহাবি : ৪/৩৯৮)। উভয় পক্ষ যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করে এ নিয়তে যে, রাসুল (সা.)-এর কন্যার ধার্যকৃত মোহরের পরিমাণটি বরকতপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধায় তা গ্রহণ করা ভালো এবং এর মাধ্যমে সুন্নতের সওয়াব লাভের প্রত্যাশা রয়েছে; তবে এ আবেগ ও অনুভূতি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয় যে, মোহরে ফাতেমি শরিয়ত নির্ধারিত দেনমোহর। তার চেয়ে কমবেশি করা অপছন্দনীয়। (রদ্দুল মুহতার : ৩/১০০)।
দেনমোহর নির্ধারণে ইসলামের শিক্ষা
একজন নারীর প্রকৃত দেনমোহর ‘মহরে মিছিল’। সেটি হলো, স্ত্রীর পিতার দিকের বিবাহিতা নারী আত্মীয় অর্থাৎ বোন, ফুফু ও চাচাতো বোনদের মধ্যে যারা দ্বীনদারি, বয়স, সৌন্দর্য, গুণাবলি, বংশমর্যাদা ও জ্ঞান-গরিমা ইত্যাদিতে তার মতো হয়, তাদের মোহরের অনুপাতে অনুরূপ দেনমোহর নির্ধারণ করা। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/৫৫৯)। স্বামী-স্ত্রী যদি চায় মহরে মিছিল থেকে কমবেশি দেনমোহর দিতে, তবে সেটার সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, ইসলামে সর্বনিম্ন দেনমোহর নির্ধারিত থাকলেও সর্বোচ্চ দেনমোহর নির্ধারিত নয়। সর্বনিম্ন মোহরের উদ্দেশ্য, স্ত্রী যদি শরিয়ত নির্ধারিত সর্বনিম্ন দেনমোহর থেকেও কম মোহরে সম্মত হয়, তবে সেটি ধার্য করা যাবে না। বরং অন্তত সর্বনিম্ন পরিমাণ ধার্য করতে হবে। হানাফি মাজহাব মতে সর্বনিম্ন দেনমোহর দশ দিরহাম। দশ দিরহাম তথা প্রায় দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা রুপা বা সমমূল্যের অর্থ। দেনমোহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিমাণে এত কম দেনমোহর নির্ধারণ না করা, যার দ্বারা কনের সামাজিক অবস্থান অবমূল্যায়িত হয়। একই সঙ্গে এত অধিক দেনমোহর নির্ধারণ না করা, যা স্বামীর পক্ষে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য কর্তব্য হলো, উভয় পরিবারের পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে উভয় দিক লক্ষ্য রেখে দেনমোহর নির্ধারণ করা।
মোহরের মালিকানা
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নারীদেরকে খুশি মনে তাদের দেনমোহর আদায় কর। তবে তারা নিজেরা যদি তা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা সানন্দে স্বাচ্ছন্দ্যভাবে ভোগ করতে পার।’ (সুরা নিসা : ৪)। এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন অভিভাবক, বর-কনেসহ বিয়ের সব পক্ষকে চারটি বার্তা দিয়েছেন- ১. দেনমোহর একমাত্র নারীর নিরঙ্কুশ অধিকার। এ অধিকারের মাঝে কারোর হস্তক্ষেপের বিন্দুমাত্র অধিকার বা সুযোগ কোনোটাই নেই। ২. স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহর থেকে বঞ্চিত কিংবা পরিশোধের পর সামাজিক বিভিন্ন হিলা বাহানা অবলম্বনের মাধ্যমে দেনমোহর ফিরিয়ে নেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েজ। ৩. অভিভাবকদের জন্য নারীদের মোহরে হস্তক্ষেপ করা; যেমন- অভিভাবক নিজে মোহরের মালিক বনে যাওয়া অথবা অপর কোনো প্রয়োজনগ্রস্তকে মালিক বানিয়ে দেওয়া কিংবা স্বামীকে দেনমোহর থেকে অব্যাহতি দেওয়াসহ যে কোনো ধরনের অধিকার চর্চা অভিভাবকদের জন্য হারাম। ৪. কোনো মেয়ে যদি স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিভাবক কিংবা স্বামীকে মোহরে হস্তক্ষেপের অনুমতি প্রদান করে, তবে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য সেটি জায়েজ হবে। এক কথায়, দেনমোহর অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের মতো একটি স্বতন্ত্র আর্থিক লেনদেন; যা তার মালিক বা মালিকের অনুমতি ছাড়া অন্য কারোর জন্য হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/৪২৯)।