যে কোনো সভ্যতার প্রতিষ্ঠা, তার উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি নির্ভর করে সেই সভ্যতার মূলনীতি, মূল্যবোধ এবং জীবনদর্শনের বিশেষ ভঙ্গির ওপর। তদ্রƒপ তার স্থায়িত্ব ও শক্তি নির্ভর করে মানুষের আচার-আচরণ ও শিক্ষাদীক্ষা অনুশীলনে তার সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ওপর। একটি সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম আরাধ্য নাগরিক মূল্যবোধের পরিগঠন। উন্নত মূল্যবোধ সভ্যতার প্রাণ। কোনো সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করতে হলে এবং তার কর্মপদ্ধতিতে শৃঙ্খলা আনতে হলে উন্নত মূল্যবোধ চর্চার বিকল্প নেই। উন্নত চরিত্র জাতি বিনির্মাণের মূলভিত্তি। চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়, মুক্তি ঘটে ধ্বংস ও পতনের সমূহ আশঙ্কা থেকে। উন্নত মূল্যবোধ ও সুমহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনুপস্থিতি সমাজবদ্ধ জীবনযাপন অসম্ভব করে তোলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘উৎকৃষ্ট ভূমিতে রবের হুকুমে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়। আর যে ভূমি মন্দ, তাতে শুধু অসম্পূর্ণ ফসলই উৎপন্ন হয়। এভাবেই আমি কৃতজ্ঞদের জন্য নানা আঙ্গিকে নিদর্শনাবলি বর্ণনা করি।’ (সুরা আরাফ : ৫৭)।
চারিত্রিক মূলনীতি ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়
মানুষের কর্মে তার হৃদয়বৃত্তির প্রভাব থাকেই। মনোচরিত্রে সৌকুমার্য থাকলে বাহ্যিক আচরণে তা ফুটে ওঠে। চারিত্রিক সৌন্দর্র্যের বিভায় মানুষের কর্ম সৌন্দর্য লাভ করে। যে সমাজের সভ্যরা উন্নত চারিত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ নয়, সে সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্যের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের কর্মে, আচরণে বিভেদণ্ডবিচ্ছিন্নতা ও ধ্বংসের চিত্রই শুধু ফুটে ওঠে। বস্তু-জাগতিক উন্নতি-অগ্রগতি সভ্যতার উৎকর্ষের মানদণ্ড নয়। মানুষের জীবন ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতার ভিত্তিতেই সভ্যতার উন্নতি অগ্রগতি পরিমাপিত হয়। পুঁজির প্রবৃদ্ধি, নতুন নতুন আবিষ্কার, উদ্ভাবন- শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য যথেষ্ট নয়। চারিত্রিক মূলনীতি ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বিচ্ছিন্ন নয় বৈশ্বাসিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকেও। ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষাদীক্ষা থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। ইমাম শাতিবি (রহ.) বলেন, ‘শরিয়ত হচ্ছে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া। সুশৃঙ্খল বিধান প্রণয়ন ও আচার-আচরণের সংশোধনের নামই শরিয়ত।’ এরপর তিনি বলেন, ‘এটিই দুরবস্থা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।’
ধর্মপরায়ণতাই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সারকথা
যার চরিত্র যত উন্নত, তার ধার্মিকতা তত সমৃদ্ধ। সচ্চরিত্র ছাড়া ধর্মপরায়ণতা মূল্যহীন, ধর্মপরায়ণতাও নিরর্থক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছাড়া। বিশুদ্ধ চরিত্র, সঠিক মূল্যবোধ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকমের হয় না। এটি একটি স্থির ব্যাপার। শত্রু-বন্ধু, আত্মীয়-অনাত্মীয়, শক্তিশালী-দুর্বল, বিজয়ী-বিজিত, পাপী-পুণ্যবান- সবার বেলায় এটি বজায় রেখে চলতে হবে। কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বল।’ (সুরা বাকারা : ৮৩)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে উত্তম চরিত্রসহ জীবনযাপন কর।’ (তিরমিজি)। স্বার্থবাদী মানসিকতা থেকে উত্তম চরিত্র প্রদর্শন চরম নীচতার পরিচায়ক। এভাবে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে নিজেকে উপস্থাপন মূল্যবোধহীন স্বার্থবাদী রাজনীতির শামিল।
মানবীয় মূল্যবোধের অনুপস্থিতিতে যা বর্তমান
মানবতা আজ নানামুখী ভীতি ও অস্থিরতার সম্মুখীন। পরিবেশ পরিস্থিতি ক্রমশ অধঃমুখী। বনে-জঙ্গলে দাবানল। নদীতে নাব্যতার সংকট। বিশ্ব পরিস্থিতি চরম সংকটাপন্ন। জাতিতে জাতিতে বিভক্তি। চারদিকে হত্যা, লুণ্ঠন, উদ্বাস্তুকরণ, দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা। এর সবই হচ্ছে মানবীয় মূল্যবোধের অনুপস্থিতি, ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন, আত্মঅহমিকা বৃদ্ধি, কুপ্রবৃত্তির দাসত্বে নিমজ্জমানতা, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশায় স্বাধীনতা থাকার কারণে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণেই জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে তিনি কিছু কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করান; যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)।
মূল্যবোধের অনুপস্থিতি ধ্বংস ও বিনাশের কারণ
ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তচিন্তার নামে বিচ্যুতি ও নাস্তিকতা ছড়িয়ে পড়েছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে গেছে। মানুষ আজ সমকামিতায় পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে। এটি চরম বিচ্ছিন্নতা ও নির্লজ্জতা। এর আগে পৃথিবীতে এমনটি আর দেখা যায়নি। এরা যেন সেই অভিশপ্ত সম্প্রদায়ের ভাষায় সৎলোকদের সম্পর্কে বলছে, ‘তাদের তোমরা নিজেদের গ্রাম থেকে বের করে দাও। এরা এমন লোক, যারা অতি পবিত্র হতে চায়।’ (সুরা আরাফ : ৮২)। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুদ্ধ বন্ধের আশ্বাসবাণী শোনায়। ন্যায় ও সাম্যের বুলি আওড়ায়। মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বক্তব্য দেয়। সেই তারাই আবার মনে করে, বস্তু জাগতিক উন্নতি আধ্যত্মবোধের শূন্যতা পূরণে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমেই বিশুদ্ধ মূল্যবোধ, উন্নত চরিত্রের বিস্তার ঘটবে। এমনটি যারা মনে করে, তারা নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ততার মাঝে রয়েছে। তারা অযাচিত শারীরিক চাহিদার পাঁকে ডুবে আছে। পার্থিব আকাঙ্ক্ষা তাদের অন্ধ করে ফেলেছে। তারা সব ধরনের চারিত্রিক বন্ধন থেকে মুক্তি কামনা করছে। আর বাস্তবতা হলো, মূল্যবোধ যেখানে দুর্বল হয়ে পড়ে, মানুষ সেখানে ধ্বংস ও বিনাশের হাতিয়ারই তৈরি করে।
সভ্যতার সঙ্গে সংস্কৃতির ও জ্ঞানের সঙ্গে আচরণের সংযোগ
পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চরম উৎকর্ষে উপনীত হয়েছে। এটি অনস্বীকার্য। এর পেছনে যাদের অবদান, তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, চিকিৎসা, যোগাযোগব্যবস্থা, মহাকাশবিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে আল্লাহর প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠাও লক্ষণীয়। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখন, যখন এসবের মোহে পড়ে চরিত্র ও মূল্যবোধকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। বিশুদ্ধ মূল্যবোধ, সৎকর্ম ও হৃদয়বৃত্তির চর্চাটা বন্ধ হয়ে পড়ে। মূল্যবোধ সভ্যতার সঙ্গে সংস্কৃতির এবং জ্ঞানের সঙ্গে আচরণের সংযোগ ঘটায়। নাগরিক মূল্যবোধই একটি জাতির প্রাণ। এটিই আলো, যার সাহায্যে মানুষ বিশুদ্ধ জীবনযাপনে দিশা গ্রহণ করে থাকে। আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে যে বার্তাসহ প্রেরণ করেছেন, সেটিই আমাদের প্রকৃত জীবনের সন্ধান দেয়। কোরআন মাজিদে এসেছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ডাকে সাড়া দাও, যখন রাসুল তোমাদের এমন বিষয়ের দিকে ডাকেন, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন।’ (সুরা আনফাল : ২৪)। বরং রেসালাতের সেই বার্তাই মূলত প্রাণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এভাইে আমি নিজ আদেশে আপনার প্রতি এক রুহ প্রেরণ করেছি। আপনি জানতেন না, কিতাব কী, ঈমান কী! কিন্তু আমি এ কোরআনকে এক নুর বানিয়েছি; যা দ্বারা আমার বান্দাদের মাঝে যাকে ইচ্ছে পথ প্রদর্শন করি।’ (সুরা শূরা : ৫২)। আল্লাহর এ বার্তা এক আলোকবর্তিকা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে গেছে আলো ও এমন সুস্পষ্ট কিতাব, যা দ্বারা যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুগত হয়, তাদের তিনি শান্তির পথসমূহ প্রদর্শন করেন, নিজ আদেশে তাদের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোর দিকে নিয়ে আসেন; আর তাদের পরিচালিত করেন সরল পথে।’ (সুরা মায়িদা : ১৫-১৬)।
নবীজীবনে উন্নত মূল্যবোধের স্বাক্ষর
রাসুল (সা.) এর জীবন-চরিতেও পাওয়া যায় উন্নত মূল্যবোধের স্বাক্ষর। রাসুল (সা.) হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন। জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে প্রথম ঐশী প্রত্যাদেশ এলো তার কাছে। তিনি সন্ত্রস্ত হলেন। বাড়ি ফিরে এলেন। খাদিজা (রা.)-কে খুলে বললেন সবকিছু। খাদিজা (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! তিনি কখনোই আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন। অসহায় দুর্বলদের দায়িত্ব বহন করেন। নিঃস্বকে সাহায্য করেন। অতিথিদের আপ্যায়ন করেন। দুর্দশাগ্রস্তকে সহায়তা করেন।’ (বোখারি : ৩)। ঐশী প্রত্যাদেশ আসতে থাকে। নবীজীবনে তা প্রতিফলিত হতে থাকে। তার মাঝে স্থাপিত হতে থাকে কোরআনি মূল্যবোধ। নবীপত্নী আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)-এর চরিত্রের বিবরণে বলেন, ‘তার চরিত্র ছিল কোরআনেরই অনুরূপ।’
মানুষ ও মানবতার সংশোধনে একমাত্র পন্থা
ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মনির্দেশিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আঁকড়ে ধরা ছাড়া মানুষ ও মানবতার সংশোধনের কোনো পথ নেই। ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধই মুসলিম জাতিসত্তা গঠনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এটি মুসলমানদের এমন এক সভ্যতা উপহার দিয়েছে, যা অন্য কোথাও অনুপস্থিত। পনেরো শত বছর পেরিয়েছে, এখনও পৃথিবী ইসলামি মূল্যবোধ থেকে অমুখাপেক্ষী নয়। দয়া, মায়া, ন্যায়, সাম্য, উদারতা, মধ্যপন্থা ইত্যাদি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের ভূমিকার সঙ্গে অন্য কোনো মতাদর্শের তুলনা হতে পারে না। বিশুদ্ধ বিশ্বাস, উন্নত চরিত্র, মানবতার উপযোগী বিধান- এ সবই মূলত ইসলামি সভ্যতা প্রতিষ্ঠায় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বিধান শুধু কিতাবে নয়, জীবনেও পালিত হতে হবে; এ-ই ধর্মের নিদের্শনা। উন্নত চরিত্র প্রতিফলিত হতে হবে বাহ্যিক আচরণেও। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীলতা ও মন্দ কাজে বাধা প্রদান করে।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৫)। তিনি আরও বলেন, ‘আপনি তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করুন, যা দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে দেবেন।’ (সুরা তওবা : ১০৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ স্থির করে নেয়, তার জন্য হজের সময় স্ত্রী সম্ভোগ, পাপাচার ও কলহ-বিবাদ বৈধ নয়।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)।
ইসলামি মূল্যবোধ ও উন্নত চরিত্র জানতে করণীয়
ইসলামি মূল্যবোধ ও উন্নত চরিত্র সম্পর্কে আরও বেশি জানতে হলে যুদ্ধকালীন ইসলামের নিদের্শনার প্রতি লক্ষ্য রাখাই যথেষ্ট। যুদ্ধ যখন তীব্রতা লাভ করে, কেউ কারও প্রতি খেয়াল করার সুযোগ থাকে না, রণ-দুন্দুভি বাজতে থাকে শত্রু শিবিরে, ঠিক তখন মুসলিম সেনাপতি নিজের সৈন্যদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতা করো না। অঙ্গবিকৃত করো না। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করো না। খেজুর ও অন্য কোনো ফলদার গাছ কর্তন করো না, জ্বালিয়ে দিও না। আহারের উদ্দেশ্য ছাড়া মেষ, গরু ও উট জবাই করো না। কিছু মানুষকে গির্জায় ইবাদতে মগ্ন পাবে, তাদের কাছ দিয়ে যখন তোমরা যাবে, তাদের নিজ অবস্থায় ছেড়ে দাও।’ হ্যাঁ, ইসলামে যুদ্ধের লক্ষ্য শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা পূর্ণরূপে শান্তিব্যবস্থার মাঝে প্রবেশ কর।’ (সুরা বাকারা : ২০৮)। তিনি আরও বলেন, ‘তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে। নির্ভর করবে শুধু আল্লাহর ওপর।’ (সুরা তওবা : ৬১)।
ইসলামের সর্বজনীন বৈশ্বিক সভ্যতা উপহার
রাসুল (সা.) পরবর্তী জীবনে হিলফুল ফুজুলের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অমন চুক্তির পরিবর্তে আমাকে যদি অনেকগুলো লাল উটও দেওয়া হয়, আমি তা গ্রহণ করব না। সে ধরনের চুক্তিতে এখনও আমাকে কেউ আহ্বান করলে আমি অবশ্যই তাতে সাড়া দেব।’ সেটি ছিল একটি ইতিবাচক চুক্তি; যা শান্তি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রসঙ্গে মদিনা সনদের বিষয়টিও লক্ষণীয়। দল-মত-গোত্র নির্বিশেষে মদিনায় সবাইকে যা ঐক্যবদ্ধ করেছে। মদিনার নিরাপত্তা বিধানে সবাইকে বদ্ধপরিকর করেছে। ইসলাম আমাদের একটি সর্বজনীন বৈশ্বিক সভ্যতা উপহার দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি জাতি ও গোত্রে; যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মাঝে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক সম্মানিত, যে তোমাদের মাঝে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন ও সব সংবাদ রাখেন।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)।
বিশ্ব ইসলামি চরিত্র ও মূল্যবোধের প্রতি মুখাপেক্ষী
মুসলমান ইসলামি সভ্যতা ও উন্নত চরিত্রে দীক্ষা লাভ করেছে সেই নববি যুগে। সেটি তাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। এরপর খোলাফায়ে রাশেদার যুগে, এরপর পর্যায়ক্রমে পরবর্তী ইসলামি শাসনব্যবস্থার সময়ে। ইসলামের ইতিহাসে, এমনকি সাম্রাজ্যবাদী যুগ এবং এই আধুনিক যুগেও তা সমানভাবে সংরক্ষিত। ইসলামি চরিত্র মুসলমানদের মাঝে বদ্ধমূলভাবে প্রতিষ্ঠিত। ইতিহাস, কাল ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে তাতে পরিবর্তন আসে না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবর্তন তাতে প্রভাব ফেলতে পারে না। অন্যদিকে অন্যান্য সভ্যতা অবস্থার পরিবর্তনে অবশ্যম্ভাবীভাবে তার চিত্র বদলে ফেলে। কোনো জাতির ওপর বিজয়ী হলে তারা পরাভূত থাকাকালীন মূল্যবোধ ভুলে যায়। বিজয় তাদের অত্যাচারের পথ খুলে দেয়। কিন্তু মুসলমানরা শত শত দেশ জয় করা সত্ত্বেও কোথাও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি। কোনো জনপদ বিরান করেনি। যারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি, তাদের হত্যা করেনি। অন্যরা কোনো দেশে বিজয়ী হয়ে প্রবেশমাত্র অবর্ণনীয় তাণ্ডব চালিয়েছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাদের সে অত্যাচারের বীভৎস চিত্র অঙ্কিত আছে। আজও বিশ্ব ইসলামি চরিত্র ও মূল্যবোধের প্রতি সমান মুখাপেক্ষী। পারস্পরিক সংলাপ ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ইসলামি মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিলে আজও রচিত হতে পারে জাতিতে জাতিতে সেতুবন্ধন। বইতে পারে উদারতা, কল্যাণ এবং ন্যায় ও সাম্যের সুবাতাস।
২৫ রজব ১৪৪৪ (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামের জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুফতি মুইনুল ইসলাম