যুবকদের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা

একটি উন্নত দেশ ও আদর্শ জাতি গঠনে বড় ভূমিকা ও অবদান রাখে দেশের যুব সমাজ। তাদের সুচিন্তা ও সুষ্ঠু মনন গঠনের মধ্য দিয়ে একটি দেশ তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে শক্তি ও সাহস পায়। সুশীল সমাজ ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র গঠনে যুবশক্তির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ জন্য যৌবনকালকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। যৌবনকাল কীভাবে কাটানো উচিত, তা নিয়ে লিখেছেন- মুহাম্মদ ইকরামুল ইসলাম

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহর আনুগত্য করা

মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো, যৌবনকাল। যৌবনে মানুষ অসাধ্য সাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারে। রাসুল (সা.) যৌবনকালকে গনিমত মনে করতেন। আমর ইবনে মায়মুন আল আওদি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে উপদেশকালে বলেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয় আসার আগে গনিমত মনে করো; বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (সুনানে বায়হাকি : ১০২৪৮)। তা ছাড়া যৌবনে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে কাটানোর অনেক গুরুত্ব, আলাদা তৃপ্তি ও মূল্যায়ন রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যেদিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা তার নিজের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। এর মধ্যে একজন সেই যুবক, যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতে।’ (বোখারি : ৬৬০)।

সর্বদা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা

বর্তমানে যুবকদের বড় একটা অংশ বেকার ও হতাশার জীবনযাপন করছে। আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্য ও তার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভরসা ছাড়া পার্থিব নানা উপায়-উপকরণের মাধ্যমে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ও উন্নত ক্যারিয়ার গড়তে যখন ব্যর্থ, তখন তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশা ও অমানিশার অন্ধকার। ইসলাম তাদের এ অবস্থা থেকে উঠে এসে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখা এবং তার সাহায্য কামনার নির্দেশ দিয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন তিনি বাহনে রাসুল (সা.)-এর পেছনে ছিলেন। তখন রাসুল (সা.) তাকে বললেন, ‘হে তরুণ! আমি কিছু কথা শেখাব, তুমি আল্লাহর নির্দেশ সংরক্ষণ করবে। তোমাকেও তিনি সংরক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর নির্দেশনা পালন করবে, তুমি তাকে তোমার সামনে পাবে। কারও কাছে সাহায্য চাইতে হলে আল্লাহর কাছে চাও। জেনে রেখো, পুরো জাতি তোমার উপকার করতে চাইলেও আল্লাহ তোমার জন্য যতটুকু লিখে রেখেছেন, ততটুকু হবে। তারা তোমার ক্ষতি করতে চাইলেও আল্লাহ তোমার জন্য যতটুকু লিখে রেখেছেন, ততটুকু হবে। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠাগুলো শুকিয়ে গেছে।’ (তিরমিজি : ২৫১৬)।

সুন্দর চরিত্র গঠনে প্রয়াসী হওয়া

পারিপার্শ্বিক নানা কারণে যুবসমাজ আজ বড় হুমকির মুখে। ক্রমে তাদের চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনাগুলো বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কুচিন্তা ও খারাপ অভ্যাস তাদের মাঝে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, অপরের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাবোধ কমে আসছে। চারিত্রিক পদস্খলন ঘটেছে চরম আকারে। ইসলাম অপরাপর সুন্দর ও উত্তমের শিক্ষা ও নির্দেশ দেয়। উত্তম চরিত্র মানুষকে আল্লাহর প্রিয় করে তোলে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তারা, যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (জামিউস সগির : ২১৮)। আবু দারদা (রা.) এক হাদিসে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন মোমিনের দাঁড়িপাল্লায় উত্তম চরিত্রের চেয়ে ভারী আর কিছু হবে না। কেননা, আল্লাহতায়ালা অশ্লীল কটুভাষীকে ঘৃণা করেন।’ (তিরমিজি : ২০০২)। মুসলিম যুবকের উচিত, উত্তম চরিত্র গঠনে প্রয়াসী হওয়া। আর এ জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। রাসুল (সা.) সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সুন্দর চরিত্র গঠনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার চরিত্রকে সুন্দর করুন, যেমনিভাবে আপনি আমার শারীরিক গঠনকে সুন্দর করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩৮২৩)।

পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতা আমাদের জীবনমান উন্নত ও সমৃদ্ধ করলেও কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। পরিবার ও মা-বাবার সঙ্গে সন্তান ও অনুজদের দীর্ঘ গ্যাপ ও দূরত্ব এর মধ্যে অন্যতম। অথচ সন্তানের নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শিক্ষার আদর্শ পাঠশালা হলো পরিবার। পরিবারের সঙ্গে সন্তানের ঘনিষ্ঠতা যত বেশি হবে, অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও তত কমে আসবে। সন্তানের প্রতি পরিবারের যেমন কিছু দায়িত্ব আছে, তেমনি পরিবারের প্রতিও সন্তানের কিছু কর্তব্য রয়েছে। মালেক ইবনে আল হুওয়াইরিস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমরা সমবয়সী কয়েকজন যুবক একবার রাসুল (সা.)-এর কাছে এলাম। এরপর তার কাছে প্রায় ২০ দিন অবস্থান করলাম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহপরায়ণ। তিনি লক্ষ্য করলেন, আমরা হয়তো পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের কে কে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এসেছ?’ আমরা তাকে বললাম। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমরা পরিবারের কাছে ফিরে যাও। তোমাদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাও। তাদের শিক্ষা দাও। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ জানাও। আর নামাজের সময় যেন তোমাদের একজন আজান দেয়। অতঃপর তোমাদের কোনো প্রবীণ ব্যক্তি যেন তোমাদের ইমাম হন।’ (বোখারি : ৬৩১)।

নেশাদ্রব্য পরিহার করা

এ কথা তিক্ত হলেও সত্য, বর্তমানে যুবকদের বৃহৎ একটা অংশ নানা জাতীয় মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদক গ্রহণের ফলে মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতা ও সক্রিয়তা নষ্ট হয়ে যায়। শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। একসময় মানবজীবনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। এ জন্য মাদক গ্রহণকে ইসলামে বড় অপরাধ তথা হারাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নেশাদ্রব্যই মাদক। আর প্রত্যেক নেশাদ্রব্যই হারাম।’ (মুসলিম : ২০০৩)। মাদকদ্রব্য গ্রহণকারীর শাস্তি সম্পর্কে জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নেশাদ্রব্য হারাম। আল্লাহতায়ালার ওয়াদা, যে ব্যক্তি নেশাদ্রব্য পান করবে, আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তাকে তীনাতুল খাবাল পান করাবেন।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তীনাতুল খাবাল কী?’ তিনি বললেন, ‘জাহান্নামিদের ঘাম অথবা জাহান্নামিদের পুঁজ।’ (মুসলিম : ২০০২)। এ ছাড়া জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দশজন ব্যক্তিকে রাসুল (সা.) অভিসম্পাত করেছেন; তারা হলো- ‘মাদক তৈরি করা যার পেশা, যে নিজের জন্য মাদক তৈরি করে, যে মাদক গ্রহণ করে, যে বহন করে, যার জন্য বহন করা হয়, যে পরিবেশন করে, যে বিক্রি করে, যে মাদকের মূল্য খায়, যে মাদক ক্রয় করে এবং যার জন্য ক্রয় করা হয়।’ (তিরমিজি : ১২৯৫)।

একজন যুবক যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তখন সে তার কর্তব্যজ্ঞান ও স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। অলীক এক কল্পনা ও স্বপ্নসমুদ্রে ভাসতে থাকে। কাঙ্ক্ষিত সবকিছুকে সে তার পেশিশক্তির বলে অর্জন করতে ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। নানা অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। আবার স্বার্থ হাসিলে ব্যর্থ হলে নিজের প্রাণ কেড়ে নিতেও কুণ্ঠিত হয় না। সে আল্লাহতায়ালার এ কথা ভুলে যায়, ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ- এ সব বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’ (সুরা আনআম : ৬২)।

জীবন ও যৌবনের সৌন্দর্য

জীবন ও যৌবনের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে আল্লাহর আনুগত্য, রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের পাশাপাশি সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ভালোবাসার মাধ্যমে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আবু হুরায়রা! আল্লাহভীরু হও, তুমি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ইবাদতকারী হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহপ্রদত্ত রিজিকে সন্তুষ্ট হও, সবচেয়ে ধনী হবে। তুমি নিজের ও পরিবারের জন্য যা পছন্দ করো, তা অন্য মুসলমান ও মোমিনের জন্য পছন্দ করো। নিজের জন্য যা অপছন্দ করো, তা অন্যের জন্য অপছন্দ করো। তাহলে তুমি পরিপূর্ণ মোমিন বলে গণ্য হবে। পড়শির সঙ্গে সুন্দরভাবে থাকো, তুমি পরিপূর্ণ মুসলমান বলে গণ্য হবে। বেশি হাসা পরিহার করো। কারণ, বেশি হাসা অন্তর মৃত হওয়ার মতো।’ (তিরমিজি : ২৩০৫)।