যৌবন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়
তারুণ্য একদিকে যেমন পার্থিব জীবন বিনির্মাণের মোক্ষম হাতিয়ার, তেমনি অপার্থিব বিজয় ও গৌরব অর্জনেরও মহান সোপান। ফকফকে পূর্ণিমা চাঁদের স্নিগ্ধ আলো যেমন দিন কয়েক পর বিদায় নেয় বিলীয়মান ছায়ার মতো, তেমনি শক্তির রসে টইটম্বুর চোখ ধাঁধানো যৌবনও অল্প দিনের। জীবনকে সফল, প্রাণবন্ত ও অর্থময় করতে হলে যৌবন-বসন্তকে কাজে লাগাতে হবে। এ অমূল্য হীরকখণ্ড নিয়ে লিখেছেন- আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যৌবন আল্লাহর অমূল্য নেয়ামত
আমাদের জীবন-যৌবন, সহায়-সম্পদ মহান সৃষ্টিকর্তার অমূল্য দান, শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। ক্ষণিকের এ জীবনের স্বর্ণপ্রহর হচ্ছে যৌবনকাল, যা মহান আল্লাহ বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য জীবনের মাঝামাঝি সময়ে দিয়ে থাকেন। মানব বাগানে একটি শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন সে থাকে অত্যন্ত দুর্বল। আবার যখন বার্ধক্য এসে হানা দেয়, তখনও হয়ে পড়ে দুর্বল, পরনির্ভরশীল। এ দুই প্রান্তের দুর্বলতার মাঝখানে শক্তি-সামর্থ্যে টইটম্বুর সবলতা দান করেন দয়াময় আল্লাহ। যার সদ্ব্যবহার করে মানুষ বিশ্বজয় করতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সেই সত্তা, যিনি তোমাদের সৃষ্টি শুরু করেছেন দুর্বল অবস্থা থেকে, দুর্বলতার পর তিনি দান করেন শক্তি, আবার শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা চান, সৃষ্টি করেন। তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সুরা রুম : ৫৪)। এ অমূল্য নেয়ামতকে সময় থাকতেই কাজে লাগানো উচিত। অন্যথায় হারিয়ে গেলে শত আফসোস করেও কোনো লাভ হবে না। মহাজ্ঞানী সাহাবি আলী (রা.) আক্ষেপ করে বলতেন, ‘আমি কাঁদি আমার হারানো যৌবনের স্মরণে। আহ, একবার যদি ফিরে পেতাম তা এ জীবনে! যৌবন যদি কেনাবেচা হতো এ ধরায়! তুলে দিতাম বিক্রেতার হাতে সে যা চায়।’
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ
পৃথিবীর দেশে দেশে যুগ-যুগান্তরে সৃজন, নির্মাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে জাতির সূর্য সন্তান যুবকরাই। তাদের রক্তেই রচিত হয়েছে বিজয় ও সাফল্যের কাঙ্ক্ষিত বাণী। তাই তো স্বপ্ন ও সৃজনে যেমন দেশ ও জাতি তাকিয়ে থাকে যুবসমাজের দিকে, সংকট ও ক্রান্তিলগ্নেও পথ চেয়ে থাকে তরুণসমাজের প্রতি। সাহসে-শপথে বলীয়ান যুবকদের গৌরবময় কীর্তিগাথা এখনও জ্বলজ্বল করছে সোনালি ইতিহাসের পাতায় পাতায়। মরেও তারা বেঁচে আছে জনমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। দূর অতীতের এমনই এক ঈমানদীপ্ত ঘটনা কালো কালির হরফে আজও চিরস্মরণীয় হয়ে সংরক্ষিত আছে ঐশীগ্রন্থ কোরআনে। সমকালীন বেঈমান অপশক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে কয়েকজন যুবক সমর্পিত হয়েছিল আল্লাহর একত্ববাদে। ফলে তিনি তাদের সাহায্য করেছিলেন অলৌকিকভাবে। এ ক্ষুদ্র যুবক কাফেলা আসহাবে কাহাফ নামে খ্যাত। মহান আল্লাহ সর্বকালের যুবকদের পথনির্দেশকরূপে এ বিস্ময়কর কাহিনীর আলোচনা করেছেন পবিত্র কোরআনে এভাবে, ‘আমি তোমার কাছে তাদের ঘটনা যথাযথভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল একদল যুবক, যারা নিজ প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদেরকে হেদায়াতে প্রভূত উৎকর্ষ দান করেছিলাম। আমি তাদের অন্তর সুদৃঢ় করে দিয়েছিলাম। এটা সেই সময়ের কথা, যখন তারা উঠল এবং বলল, আমাদের প্রতিপালক তিনিই, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিক। আমরা তাকে ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ বানিয়ে কখনোই ডাকব না। আমরা যদি সেরকম করি, তবে নিঃসন্দেহে চরম অবাস্তব কথা বলব।’ (সুরা কাহফ : ১৩১৪)।
যৌবন প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ হবে হাশরে
সময়ের পরিক্রমায় জীবনের এ স্বর্ণপ্রহর হারিয়ে গেলে সারা পৃথিবীর বিনিময়েও তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না। এ নেয়ামতের মূল্য তারাই বোঝে, যারা এ থেকে বঞ্চিত। সাত রাজার ধনের চেয়েও মূল্যবান এ সম্পদ এখনও যাদের আছে, তারা সত্যিই বড় সৌভাগ্যবান। যারা এ নেয়ামতকে যথার্থ মূল্যায়ন করে, তাদের ইহ-পরকালে সফল হয়। আর যারা এটাকে হেলায় খেলায় নষ্ট করে, তারা হয় চরম ক্ষতিগ্রস্ত, প্রবঞ্চিত। প্রতিটি মানুষকে হাশরের ময়দানে অনুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে তার জীবন ও যৌবনের। বিশ্বমানবতার প্রকৃত বন্ধু প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ভাষায়, ‘কেয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার আগ পর্যন্ত আদম সন্তানের পা আল্লাহর কাছ থেকে সরাতে পারবে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, কীভাবে তা অতিবাহিত করেছে? তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কীভাবে তা বিনাশ করেছে? তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে এবং কী কী খাতে তা ব্যয় করেছে? আর সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল, তা কতটুকু মেনে চলেছে?’ (তিরমিজি : ২৪১৬)।
বার্ধক্যের আগেই হোক যৌবনের মূল্যায়ন
একজন সত্যনিষ্ঠ যুবক যখন বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে একটি ভেঙে পড়া পরিবারের ভার তুলে নেয় কাঁধে, অমনি অভাবের ভারে ন্যুয়ে পড়া পরিবারটি সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। পরিবারটি মেরুদণ্ড সোজা করে দেখতে শুরু করে পৃথিবী আলো করা স্বপ্ন। দায়িত্বশীল তরুণের ছোঁয়ায় তরতরিয়ে এগিয়ে যায় একটি মানব কাফেলা। একজন স্বপ্নবাজ তরুণ আপন শক্তিতে জ্বলে ওঠে। নিজ কর্মদক্ষতায় হাসিয়ে তুলতে পারে চারপাশ। দূর করতে পারে গরিব-দুঃখীদের অভাব অনটন। ফোটাতে পারে অসহায়দের মুখে তৃপ্তি ও প্রাপ্তির হাসি। এর সদ্ব্যবহার করে মানুষ গড়ে তুলতে পারে সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্নিল নীড়। তাই নবীজি (সা.) সযত্ন সর্তকতায় কাজে লাগাতে বলেছেন জীবনের এ স্বর্ণ প্রহরকে। তিনি এক ব্যক্তিকে কিছু অমূল্য উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচটি বিষয়ের আগেই মূল্য দাও- বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে ধনাঢ্যতাকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (মুসতাদরাকে হাকিম : ৭৮৪৬)।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল
ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম