তাকওয়া একটি পোশাক। পোশাক যেমন মানুষকে ঠান্ডা-গরম, যুদ্ধ-বিগ্রহ বিপদণ্ডমসিবত থেকে রক্ষা করে, তাকওয়া তেমনি পাপ-পঙ্কিলতাসহ যাবতীয় অপরাধ থেকে রক্ষা করে। পোশাক যেমন দেহের সৌন্দর্য বাড়ায়, তাকওয়া তেমনি সামগ্রিক সত্তার সৌন্দর্য বাড়ায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাকওয়ার পোশাকই সর্বোৎকৃষ্ট পোশাক।’ (সুরা আরাফ : ২৬)। তাকওয়া হলো, আল্লাহকে ভয় করে চলার রীতি। যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার নীতি। সব জায়গায়, সব কর্ম সম্পাদনে আল্লাহ ‘আমায় দেখছেন’ এমন কল্পনা হৃদয়ে জাগরুক রেখে কলুষমুক্ত জীবন গড়ার নাম। যার সাধনা সারাজীবন করে যেতে হয়। ওমর (রা.) উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উবাই ইবনে কাব (রা.) উত্তর দিলেন, ‘আমিরুল মোমিনিন! আপনি কখনও কাঁটাযুক্ত রাস্তা, কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন? করলে কীভাবে?’ উত্তরে ওমর (রা.) বলেন, ‘খুব সতর্ক হয়ে, যেন কোনো কাঁটা শরীরে না বিঁধে, আঁচড় না লাগে।’ উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ‘এটাই তাকওয়া।’
তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা
দ্বীনের পথে আল্লাহকে ভয় করে এমনভাবে চলা, যাতে কালিমা, কলুষতা, পঙ্কিলতা দেহে না লাগে। এ অমূল্য সম্পদ তাকওয়া যে অর্জন করবে, সে-ই মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান, যে অধিক তাকওয়াবান।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ শুধু মুত্তাকিদের (আমল) কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা : ২৭)। কে না চায় আল্লাহর প্রিয় হতে, অলি হতে! সবাই চায়। তবে শুধু চাইলেই তো আর কিছু হওয়া যায় না। কবির ভাষায়, ‘মুক্তি চাও, তো চল না মুক্তির পথে! নৌকা তো আর শুকনো জায়গায় চলে না।’ এর জন্য প্রয়োজন তাকওয়া অর্জন করা।
তাকওয়া অর্জনের মোক্ষম সময়
তাকওয়া অর্জনের মোক্ষম সময় ও সুবর্ণ সুযোগ হলো, পবিত্র রমজান মাস। রমজানেই মানুষ সাধনা করার প্রয়াস পায়, নিজেকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ মেলে। রমজান যেন আল্লাহভীরু ও প্রকৃত মানুষ গড়ার প্রশিক্ষণশালা। অন্য ইবাদতে যে রিয়া ও লৌকিকতার সুযোগ থাকে, রোজার বেলায় তা থাকে না। কারণ, একজন রোজাদার ইচ্ছে করলে আড়ালে রোজা ভেঙে ফেলতে পারেন। অজু করার সময় বা ডুব দিয়ে গোসলের সময় একটু পানি খেয়ে নিলে কিংবা খালি বাড়ি বা নির্জন কক্ষে স্ত্রী সম্ভোগ করে নিলে দুনিয়ার কেউ দেখবে না। খাদ্যের বাহারি আইটেমসহ রোজা ভাঙার সব সরঞ্জাম হাতের নাগালেই আছে। তা সত্ত্বেও রোজাদার রোজা ভাঙেন না। তিনি ভাবেন, দুনিয়ার কেউ না জানুক-না দেখুক, আমার আল্লাহ তো দেখেন। আল্লাহর ভয়ে পানাহার ও সম্ভোগ থেকে বিরত থাকেন। এভাবে পুরো মাসে ৩৬০ ঘণ্টা সাধনা করা যেন রমজানের প্রতি ১ ঘণ্টা পুরো বছরের ১ দিনের জন্য একটি করে কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিক। যদি সত্যিকারার্থেই রোজার হক আদায় করে রোজা রাখা যায়, তাহলে সারা বছর তাকওয়ার ওপর চলা সহজ হয়ে যায়।
তাকওয়াবানদের জন্য মহাপুরস্কার
প্রকৃত মোমিন-মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে চারটি পুরস্কার- ১. পাপ মোচন, ২. নেক আমলের (বড়) উত্তম প্রতিদান, ৩. দুনিয়ার সংকট ও আখেরাতের বিপদ থেকে মুক্তি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে তাকওয়া (আল্লাহকে ভয় করে) অবলম্বন করে, আল্লাহ তার পাপরাশি মোচন করে দেন এবং মহাপুরস্কার দান করেন।’ (সুরা তালাক : ৫)। তিনি আরও বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য (নিষ্কৃতির) পথ খুলে দেন। অকল্পনীয় জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেন।’ (সুরা তালাক : ২-৩)। ইহ-পরকালে সে-ই প্রকৃত সুখী, এ চারটি বস্তু যার অর্জিত হবে। মুত্তাকিদের গুণাবলি কোরআন-সুন্নাহর বিভিন্ন জায়গায় আলোচিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে সফলতা- প্রাচীর বেষ্টিত বাগান ও আঙ্গুর, সমবয়ষ্কা যুবতীর দল।’ (সুরা নাবা : ৩১-৩৩)।
রোজার বরকতে যা অর্জিত হয়
সময় সচেতনতা : একজন রোজাদার নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার করার প্রতীক্ষায় থাকে। সুতীক্ষè খেয়াল রাখে, এক মিনিট আগেও যেন ইফতার না হয়। ইফতারের পর নামাজ। নামাজের পর একটু বিশ্রাম নিতেই তারাবি। তারাবি শেষে শুতেই চোখে নামে রাজ্যের ঘুম। কিন্তু না, সারারাত ঘুমানোর সুযোগ নেই। উঠে যেতে হয় তাহাজ্জুদ ও সেহরির জন্য। সেহরিতেও রাখতে হয় বিশেষ নজর। যেন নির্ধারিত সময়ই শেষ করা যায় সেহরি। এরপর ফজরের সালাত। তারপর হারিয়ে যাওয়া সারাদিনের কর্মযজ্ঞে। এভাবেই একসময় বান্দার মাঝে নিয়মানুবর্তিতা ও সময় সচেতনতা সৃষ্টি হয়ে যায়।
মৌলিক গুণাবলি : রোজাদার চিন্তা করেন, রোজা রাখার কারণে হালাল জিনিসগুলো যেহেতু হারাম হয়ে গেছে, তাহলে হারামগুলো তো আরও কঠিনভাবে নিষিদ্ধ হবে। ফলে মিথ্যা, গিবত-শেকায়েত, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইসহ সব ধরনের পাপ কাজ ছাড়ার অভ্যাস ও মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়। প্রকৃত রোজাদারের স্মরণে থাকে নবীজি (সা.)-এর হাদিস- যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা-গিবত ও ঝগড়াঝাটি পরিহার করল না, তার ক্ষুৎ-পিপাসায় আল্লাহর কিছুই আসে যায় না।’ (বোখারি : ১৯০৩)।
ত্যাগ ও সহনশীলতা : ক্ষুৎ-পিপাসার তীব্রতা রোজাদারকে ধৈর্য, সংযম, ত্যাগ ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। ফলে জীবনের যে কোনো পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জিত হয়। অভুক্ত, অভাবী ও অনাহারীর কষ্ট অনুভব করতে পারে। তাদের প্রতি সুবিচারী হতে উদ্বুদ্ধ করে।