দিন দিন অভক্তি বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে সরোয়ার সাহেবের কোলাহলময় কথাবার্তাও। তার রাগের পরিধি যেন আগের থেকেও তুঙ্গে উঠেছে। জাহানারা বেগমকে সহ্য হয় না। প্রতিটি কথায় তর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। যেন নবদম্পতি, সব এখনও মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস হয়নি, তাই এমন। কিন্তু না, তাদের ছেলেমেয়ে আছে। বিয়ে দিয়েছে তাদের। নাতি-নাতনিও হয়েছে। তবে এখনও কেন এত অমিল! সংসারের শুরু থেকেই কি চলছে জাহানারা ও সরোয়ার সাহেবের ঝগড়া? কিন্তু এমনটা না, বিয়ের প্রথম থেকে ভালোই ছিলেন তারা। সরোয়ার, জাহানারা দম্পতির প্রেম দেখার মতো ছিল। কত মিশুক ছিলেন, রসিকতায় পূর্ণ ছিল তাদের কথোপোকথন। ঈর্ষা করার মতো জোড়া ছিলেন তারা।
এই গত বছরের শীতেও সরোয়ার সাহেব জাহানারা বেগমকে নিয়ে রাতে দুধ চা খেতে বাইকে চড়ে দূর-দূরান্তের প্রসিদ্ধ ধারাগুলোতে যেতেন। শহরে থাকার পরও একটু গ্রামের আলো-বাতাস সরোয়ার সাহেব বেশ পছন্দ করেন। গ্রামের মায়া এখনও ভুলতে পারেননি। চাকরির সুবাদে ওই যে বিয়ের শুরুর দিকে গ্রাম ছেড়েছেন, সেই থেকে এখন শহরের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন। শহরে নিজের কেনা জমিতে তুলেছেন জাঁকজমকপূর্ণ ছয়তলাবিশিষ্ট ভবন। অর্থকড়িরও কমতি নেই। অন্য দু-চারটা ফ্যামেলি থেকে বেশ সচ্ছল। সামাজিক লোক হিসেবে এলাকার লোকজনও তাকে সম্মান করত। সরোয়ার সাহেব ছিলেন লৌকিকহীন ব্যক্তি। কথাবার্তায় হাসি ছিল প্রথম উপহার। সব মিলে শান্তিপূর্ণ জীবন ছিল।
সরোয়ার সাহেব পাল্টে গেছেন, পাল্টে গেছে তার কথাবার্তা, চাল-চলন- সববিছু। এমন রুক্ষ স্বভাবের সূচনা হয় সালিশ করতে এক দরবারে যাওয়ার পর। সেসব নেতার বেশ ধরার চেষ্টা করেন যেন। কথাবার্তায় আমিত্বভাব। কথোপকথনে চোখ রাঙানো, কারও দিকে তাকাতে গেলে ভ্রƒ কুঁচকানো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জাহানারা বেগমের প্রতিটি কাজে ভুল ধরেন। রান্নায় তো একটা না একটা দোষ ধরবেনই। আজ রাতেও তাই করলেন। ‘সংসারের দিকে একটুও খেয়াল নেই তোমার। রান্নাবান্না যা করছ, যেন ভুলে গেছ সব। আর আমাকে সম্মান করা তো দূরে থাক, সে কথা তোমাকে বলে কী লাভ!’ জাহানারা বেগম এড়িয়ে যেতে চাইলেন কথাগুলো। কিন্তু পারলেন না।
সরোয়ার সাহেবের কথা খুব গায়ে লেগেছে আজ। অন্য সময় স্বামীকে ছাড় দিলেও আজ কেন যেন সহ্য করতে পারলেন না। এবার জাহানারা বেগম বলেই ফেললেন, ‘আজকে তালিম থেকে শুনেছি, রাসুল (সা.) কখনও কোনো খাবারের দোষ-ত্রুটি ধরতেন না। ভালো লাগলে খেতেন, না হয় রেখে দিতেন।’ (বোখারি : ৫৪০৯)। এসেছেন আমার নেতা! ভাব দেখলে বাঁচি না। রাসুল (সা.) তোমার থেকে কম সম্মানিত ছিলেন? কই, তিনি তো তোমার মতো এত মুখপোড়া ছিলেন না! রসকষহীনতা যদি সম্মানের উৎস হতো, তাহলে তিনি এত সম্মানিত হলেন কী করে! কাকে কী বলছি! পরে না আবার রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা শুরু করবে। আল্লাহতায়ালা মাফ করেন!’ রেগে গিয়ে অগোছালো কথাগুলো বললেন জাহানারা বেগম।
সরোয়ার সাহেব চুপ রইলেন। তিনি তো এতক্ষণে পাল্টা অনেক কিছু বলে বসা মানুষ, তবে কিছু বললেন না। জাহানারা বেগম শান্ত হলেন। নরম কণ্ঠে বললেন, ‘শোন ছেলের বাবা! আগের তুমিকে লোকজন অনেক সম্মান করত, কিন্তু এখন তোমার যে চালচলন, আড়ালে লোকেরা তোমার নিন্দা করে। সময় থাকতে ভালো হও।’ কথাগুলো সরোয়ার সাহেবকে থমকে দেয়। নির্বাক বসে থাকেন। কিছু বলেন না। জাহানারা বেগমের কথাগুলো ভাবতে থাকেন। যেন দীর্ঘ ঘোর কেটেছে তার। সামান্য কথায় তর্কে জড়িয়ে পড়া লোকটা এতকিছু শুনেও নিশ্চুপ বসে আছেন। এমন নিশ্চুপতা দেখে জাহানারা বেগম অবাক হলেন, তিনি যে কিছু বললেন না! সরোয়ার সাহেব কি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন নাকি বুঝেও স্বীকার করার লজ্জায় আপন স্থানে অটল থাকবেন! রাসুল (সা.) বলেন, ‘কঠোর ও রুক্ষ স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ৫০৮০)।