তারাবির হাফেজদের সুখ-দুঃখ

রমজানের আগ মুহূর্ত থেকে শুরু হয় ছুটোছুটি। ইন্টারভিউ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় অনেক হাফেজকে। তারাবি পড়াতে গিয়ে তাদের অনেককে আবার নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। সালাতুত তারাবির কয়েকজন ইমামের এমন তিক্ত-মধুর গল্প শুনেছেন আবদুল্লাহ সরদার

প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইন্টারভিউ বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম

হেফজ শেষ করি পনেরোতে। বয়স তখন চৌদ্দ। রমজান সামনে। তারাবি পড়ানোর কোনো ইচ্ছেই নেই। আমার মামা জেঁকে ধরলেন। নিয়ে গেলেন সাভারের এক মসজিদে ইন্টারভিউ দিতে। বিকেল ৩টায় ইন্টারভিউ শুরু। সদ্য হাফেজ হওয়া এই আমার বুক কাঁপছে। কেমন চুপসে যাচ্ছি। অন্য যারা ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন, সবাই বড় বড়। তাদের সামনে টিকব বলে কল্পনাও করিনি। আমার সিরিয়াল এলো শুরুর দিকে। ইন্টারভিউ দিতে বসতেই ইমাম সাহেব কেমন কুটিলতাপূর্ণ হাসি দিলেন। বললেন, ‘ ইন্টারভিউ দিতে এসেছ?’ তারপর শুরু হলো প্রশ্নপর্ব। ইমাম সাহেব কঠিন থেকে কঠিনতম প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন; কিন্তু বাঁধাতে পারছেন না। সবাইকে যেখানে দুটি প্রশ্ন করছেন, আমাকে করলেন চারটা। ওঠার সময় অবশ্য বলেও দিয়েছিলেন, ‘ইয়াদ থাকলেও তোমার পড়া অত সুন্দর না।’ অবাক করিয়ে দিয়ে নাম ঘোষণায় সময় আমার নামটিই এলো। পরে অবশ্য জেনেছি, ইমাম সাহেব তার ছেলেকে রাখার জন্যই এমনটা করেছেন। এ ব্যবহারে কষ্ট পেলেও সভাপতির আচরণ ছিল চমৎকার। ওই এক বছরই ওখানে তারাবি পড়িয়েছি। অথচ তার সেই হাসিমুখটা কেমন ভাস্বর হয়ে আছে আজও মানসপটে।

* হাফেজ ফেরদৌস রায়হান

ইমাম, খেজুর বাগান জামে মসজিদ

সাভার, ঢাকা

মুসল্লিদের ভালোবাসায় সিক্ত

প্রথম তারাবি হয় ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। টানটান উত্তেজনা। এতদিন পেছনে নামাজ পড়েছি। এখন থাকব সামনে। আমার তেলাওয়াত শুনবে মানুষ! অন্যরকম উদ্যম কাজ করছিল ভেতরে। আগ্রহ নিয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিল আমার এক সহপাঠী। কিন্তু আমার এ আগ্রহে পানি ঢেলে দিল মুসল্লির বেশধারী এক চোর। প্রথম দিনেই ফোনটা হারালাম। কিন্তু এ দুঃখবোধটুকু হারিয়ে যেত, যখন দেখতাম- গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলো কী নির্মল আবেগ নিয়ে আমার কাছে আসছে। অনুরোধ করছে তাদের তেলাওয়াত শুদ্ধ করার পেছনে সময় দিতে। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট এ মানুষগুলো যখন গাছের একটা ফল ছিঁড়ে ইফতারের সময় প্লেটে দিয়ে বলত, ‘হুজুর! এটা আপনার জন্য।’ তখন অজান্তেই দু’চোখ ভিজে আসত।

* হাফেজ মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম

ইমাম, বাইতুল ফালাহ জামে

মসজিদ, রাজাপুর, ঝালকাঠি

সমালোচনার বিষয়টি কষ্টদায়ক

সারা বছর মাদ্রাসায় থাকলেও বছর শেষে কোরআন তেলাওয়াত তেমন করা হয় না। অনেক অপূর্ণতা থেকে যায়। তারাবি উপলক্ষে হলেও তেলাওয়াতে অন্তত কিছুটা পূর্ণতা আসে। ভুলো ভুলো কোরআনটি নিয়ে বসা হয়। তারাবি পড়ানোর উসিলায় সারাটা দিন তেলাওয়াতেই কাটে। এ জায়গা থেকে তারাবি পড়ানোর বিষয়টি বেশ উপভোগ করি। এটা তো পাটাতনে সিদ্ধ, মানুষমাত্রই ভুল করবে। সে হিসেবে হাফেজদের ভুল হতেই পারে। কিন্তু ভুল হলেই দু-একজন মুসল্লির কটমট করে তাকিয়ে থাকা আর বাইরে সমালোচনার বিষয়টা বেশ কষ্ট দেয়।

* হাফেজ সানাউল হক সাকিব

ইমাম, কুয়ারপাড় জামে

মসজিদ, সিলেট

তেলাওয়াতের বিড়ম্বনার শেষ কোথায়!

গেল বছর আমার তারাবি হয়নি। ইন্টারভিউর তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে কোনো জায়গায়ই দিইনি ইন্টারভিউ । দুপুরে খাচ্ছিলাম। সে সময় হঠাৎ করেই আমার হুজুরের ফোন। খাওয়া রেখে উঠে গেলাম কথা বলতে। আমাকে অবাক করে দিয়ে হুজুর বললেন, ‘তোমার তারাবি হয়েছে। পড়াবা?’ আমি আনন্দে আত্মহারা। মসজিদে গেলাম। ওখানেই তারাবি হলো। নিয়মিত তারাবি পড়াচ্ছি। হঠাৎ এক বিকেলে ইমাম সাহেব কাছে ডাকলেন। নরম সুরে বললেন, ‘হাফেজ সাহেব! আপনার পড়া তো বেশ সুন্দর। কিন্তু অনেক ধীরে হয়ে যায়। একটু দ্রুত পড়বেন।’ ওই রাতে দ্রুত পড়লাম। দু’দিন পর সভাপতি ধরলেন, ‘এত দ্রুত পড়েন কেন? ধীরে ধীরে পড়বেন।’ আমার কাছে মনে হলো, পড়ার ব্যাপারে আমার যেন কোনো স্বাধীনতা নেই। মুসল্লিদের মাঝেও এমন দু’ভাগ হলো। কেউ দ্রুত পড়তে বলল, কেউ মক্কা শরিফের রেফারেন্স টেনে বলল ধীরে পড়তে। এ বিড়ম্বনার শেষ কবে হবে, আল্লাহই ভালো জানেন!

* হাফেজ আবদুল্লাহ রাফি হাবিব

ইমাম, মসজিদে

আরাফাত, খুলনা

পরিবারের শূন্যতা ঘুচে যায়

এলাকায় কখনও তারাবি পড়াইনি। যেতে হয় দূর-দূরান্তে। পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকলেও মসজিদে এমন কিছু বন্ধু জুটে যায়, যাদের সঙ্গে বেশ ভালো সময় কাটে। পরিবারের সেই শূন্যতা অনুভব হয় না আর। তাদের বেশিরভাগ হয় স্কুল-কলেজপড়ুয়া। দ্বীনের প্রতি তাদের অসীম আগ্রহ দেখে বেশ ভালো লাগে।

* হাফেজ সালাহউদ্দিন আহমদ

ইমাম, বাইতুল মামুর জামে

মসজিদ, সুলতানশাহী

গোপালগঞ্জ