রমজানের সওগাত
আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অশেষ নেকি ও পুণ্য অর্জনের আল্লাহপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠ, পবিত্র ও মহিমান্বিত মাস রমজান। প্রকৃতির নিয়মে বছর ঘুরে যা আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে প্রতি বছরের মতো এবারও। আল্লাহর দান ও প্রতিদান লাভের জন্য এ মাসের চেয়ে মোক্ষম সময় ও অবারিত সুযোগ বান্দা কোনো মাসে অর্জন করতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার কসম! মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মোনাফেকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা, মোমিনরা এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মোনাফেকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মোমিনের জন্য গনিমত আর মোনাফেকের জন্য ক্ষতির কারণ।’ (মুসনাদে আহমদ : ৮৩৬৮)। মূলত প্রাপ্তি ও পুরস্কারের এ মাসটি যে পেল এবং তার সুফল লাভ করতে পারল, সে বড় কৃতার্থ ও সৌভাগ্যবান।
জান্নাতের পথ সুগম হয়
রমজানের চাঁদ উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের পথ সুগম হয়ে যায় এবং জাহান্নামের পথ হয় রুদ্ধ। ফলে বান্দা অতি সহজে নেক আমল করে আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করতে পারে, জান্নাতের উপযুক্ত হতে পারে এবং নিষ্কৃতি পেতে পারে জাহান্নাম থেকে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন রমজানের আগমন ঘটে, তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।’ (মুসলিম : ১০৭৯)। আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যখন রমজান মাসের প্রথম রজনীর আগমন ঘটে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জিনকে বেঁধে রাখা হয়, আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কোনো দরজা খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। ফলে কোনো দরজা বন্ধ করা হয় না। একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করতে থাকে- হে কল্যাণকামী! অগ্রসর হও, হে অনিষ্টকামী! বিরত হও। রমজানের প্রতি রাতে আল্লাহতায়ালা বহু জাহান্নামিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।’ (তিরমিজি : ৬৮২)।
দোয়া কবুল হয়
রমজানের প্রত্যেক দিনে আল্লাহতায়ালা বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রাতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন এবং প্রত্যেক মোমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘ইফতারের সময় রোজাদার যখন দোয়া করে, তখন তার দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (অর্থাৎ তার দোয়া কবুল করা হয়)।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৭৫৩)।
সামান্য আমলের অসামান্য প্রতিদান
এই মোবারক মাসে সামান্য আমল করেও অসামান্য প্রাপ্তি হাসিল করা সম্ভব, যা রমজান ছাড়া বাকি এগারো মাসে সম্ভব নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি নফল ইবাদত করবে, সে অন্য মাসের একটি ফরজ ইবাদত আদায়কারী হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি ফরজ ইবাদত করবে, সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ ইবাদত আদায়কারী হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহিহ ইবনে খোজাইমা : ১৮৮৭)। রাসুল (সা.) একজন নারীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘যখন রমজান মাস আসবে, তখন ওমরা কর। কেননা, রমজান মাসে পালিত ওমরা একটি হজের সমান।’ (মুসলিম : ১২৫৬)। এ মাসে যে রোজা রাখা হবে, তার পুরস্কার ও প্রতিদান দেবেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। রাসুল (সা.) বলেন, বনি আদমের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব বাড়িয়ে দেওয়া হয়; একটি নেকি দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে রোজা ছাড়া। কেননা, তা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। বান্দা আমার জন্যই মনোবাসনা বর্জন করেছে এবং খাবার-চাহিদা পরিহার করেছে।’ (মুসলিম : ১১৫১)।
গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়
রমজান মাসে রোজা রাখা, তারাবি পড়া এবং লাইলাতুল কদরে রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করার কল্যাণে আল্লাহতায়ালা বিগত বছরের সব গোনাহ মাফ করে দেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জুমার নামাজ এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রমজানের রোজা মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত সব গোনাহ মাফ করে দেয়, যদি কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়।’ (মুসলিম : ২২৩)। আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। এমনিভাবে যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে, তার পূর্ববর্তী জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (বোখারি : ২০১৪)। অপর আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগি করবে, তার বিগত জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (বোখারি : ৩৭)।
রোজার সুপারিশ হাসিল হয়
কেয়ামতের দিন বিভিন্ন বস্তু বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সেগুলোর অন্যতম হলো রোজা; যা খুৎপিপাসা বরদাশতকারী বান্দার পক্ষে জোরদার সুপারিশ করবে, এমনকি তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। রাসুল (সা.) বলেন, রোজা ও কোরআন কেয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে খাদ্য ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ কোরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে); অতএব, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৬২৬)।
উষ্ণ অভ্যর্থনা
কেয়ামতের দিন রোজাদারদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে স্বতন্ত্র দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘রোজাদারের জন্য জান্নাতে বিশেষ একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। এ দরজা দিয়ে রোজাদারই প্রবেশ করতে পারবে, অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। যখন সর্বশেষ রোজাদার তা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন সেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সে জান্নাতের পানীয় পান করবে। আর যে সেই পানীয় পান করবে, সে আর কখনও তৃষ্ণার্ত হবে না। (সুনানে নাসায়ি : ২২৩৬)।