রমজান মুসলমানদের আলোকপ্রাপ্তির মাস। এ মাসে রহমতের ফল্গুধারা বর্ষিত হয়; মোমিনের অন্তর সচ্ছ হয়, পরিশুদ্ধ হয়; তাদের চরিত্র হয় সুন্দর ও সুদৃঢ়। রোজাদার সবচেয়ে সুন্দর ও মহৎ যে গুণটি অর্জন করে, তা হলো ধৈর্য। রাসুল (সা.) রমজান মাসকে ধৈর্যের মাস বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে তিন দিন ও সবরের (রমজান) মাসে রোজা রাখলেই সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব হয়।’ (মুসনাদে আহমদ)। রমজানে মানুষ প্রবৃত্তির চাহিদা দমন করে। এটিও এক প্রকার ধৈর্য। এর মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য সাধিত হয়, নৈকট্য অর্জন হয়। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদানের সুসংবাদ আসে। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘রোজা আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (মুসনাদে আহমদ)।
ধৈর্য সব ইবাদতের মূল
ধৈর্য দৃঢ়তার চাবিকাঠি। ধৈর্যের মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ধৈর্য এমন এক আত্মিক শক্তি, যা মানুষকে সব অসুন্দর কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহতায়ালা আদেশ করেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ধৈর্যধারণ কর, শত্রুর মোকাবিলায় অটল অবিচল থাক এবং আল্লাহর ইবাদত ও দ্বীন রক্ষার কাজে লেগে থাক; তাহলে সফলকাম হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ২০০)। আল্লাহ ধৈর্যশীলতা ও ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ সবরকারীদের মহব্বত করেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪৬)। ধৈর্যশীলদের আল্লাহতায়ালার বিশেষ সঙ্গ লাভ হয়।
তিনি তাদের হেফাজত করেন, তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনফাল : ৪৬)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ধৈর্যধারণের চেষ্টা করে, আল্লাহতায়ালা তাকে ধৈর্যধারণের তৌফিক দেন। ধৈর্যধারণের তৌফিকের চেয়ে অধিক কল্যাণকর ও ব্যাপক কোনো উপহার কাউকে দেওয়া হয়নি।’ (বোখারি ও মুসলিম)। ওমর (রা.) বলেন, ‘ধৈর্যের মাধ্যমে আমরা সুখময় জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করেছি।’
সর্বোত্তম ধৈর্য
সর্বোত্তম ধৈর্য আল্লাহর আদেশ পালনে অটল থাকা ও নিষেধ থেকে বিরত থাকার মাঝে। এটাই ঈমানের ভিত্তি, অন্তরের পরিশুদ্ধির নিদর্শন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি আসমান-জমিন ও এতদুভয়ের মাঝে যা আছে, তার সবকিছুর রব। অতএব, তোমরা তাঁর ইবাদত কর এবং ইবাদতের জন্য ধৈর্যধারণের অনুশীলন কর।’ (সুরা মারইয়াম : ৬৫)। ইবাদতের জন্য ধৈর্যধারণের অর্থ হচ্ছে, ইবাদতগুলো যথাসময়ে সুন্দররূপে আদায় করা, তাতে নিষ্ঠা ধরে রাখা এবং এ পথে কোনো কষ্ট-ক্লেশ এলে তা সয়ে নেওয়া। আর আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে ধৈর্যধারণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, হারাম কাজে আল্লাহতায়ালা যে শাস্তি ঘোষণা করেছেন, তাকে ভয় করা এবং হারামে পতিত হওয়ার কারণগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা।
ধৈর্য সুসংবাদ বয়ে আনে
বান্দা যখন ধৈর্যকে আপন করে নেয়, দলবেঁধে তার জন্য সুসংবাদ আসতে থাকে। তাকে সৎকাজের সামর্থ্য দান করা হয়। সত্যের পথ তার জন্য আলোকজ্জ্বল করে দেওয়া হয়। এর পরিণতিতে সে লাভ করে আল্লাহর সাহায্য ও সফলতা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ধৈর্য হচ্ছে আলো।’ (মুসলিম)। রাসুল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘জেনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য ধৈর্যশীলতার সঙ্গে থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ)। ধৈর্যশীলকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া হয় অফুরান প্রতিদান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় ধৈর্যশীলকে সীমাহীন প্রতিদানে ভূষিত করা হবে।’ (সুরা যুমার : ১০)। তিনি আরও বলেন, ‘সবরের কারণে তাদের প্রতিদান হবে মনোরম উদ্যান ও রেশমী পোশাক।’ (সুরা দাহর : ১২)। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘ধৈর্যধারণে যেহেতু আত্মিক অবদমন রয়েছে, রয়েছে সীমাহীন কষ্ট-ক্লেশ, ফলে আল্লাহতায়ালাও এর প্রতিদানে দান করবেন সুপ্রশস্ত উদ্যান, সুকোমল রেশমী পোশাক, আরামদায়ক আসন, গরম থেকে সুরক্ষা দানকারী ছায়া।’
রমজানের শেষ দশকের গুরুত্ব
রমজান মাস চলে যাওয়ার আগেই তার কল্যাণ অর্জনে ব্রতী হতে হবে। শেষ দশক রমজানের শ্রেষ্ঠতম সময়। এ দশকেই রয়েছে লাইলাতুল কদর; যা হাজার মাস থেকে উত্তম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে রাতে রবের আদেশে ফেরেশতারা ও জিবরাইল অবতরণ করে সর্বপ্রকার বিষয় নিয়ে। তাদের পক্ষ থেকে ঘোষিত হয় শান্তির বার্তা। এ রাতের কল্যাণধারা জারি থাকে ভোর পর্যন্ত।’ (সুরা কদর : ৪-৫)। রাসুল (সা.) শেষ দশকে ইবাদতের জন্য যে পরিমাণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করতেন, অন্য কোনো সময় তা করতেন না। শেষ দশক এলে তিনি ইবাদতের জন্য কোমর বাঁধতেন। পরিবারকে জাগ্রত করতেন। ইবাদতের প্রাচুর্যে রাতগুলো লাভ করত অন্যরকম প্রাণময়তা।
১৬ রমজান ১৪৪৪ (৭ এপ্রিল ২০২২) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম